গ্রন্থাগারে যাওয়ার সময় নেই সাংসদদের!

জাতীয় সংসদের গ্রন্থাগারে আছে ৮৫ হাজারেরও বেশি বই। কিন্তু বিশাল সংগ্রহের এই গ্রন্থাগার ব্যবহার করেছেন মাত্র ৮১ জন সাংসদ, যা মোট সদস্যসংখ্যার ২২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। তাঁদের বেশির ভাগই আবার পত্রিকা পড়েই সময় কাটিয়েছেন। 
এই ৮১ জনের মধ্যে ৩৫ জন সাংসদ একাধিকবার গ্রন্থাগারে গিয়েছেন। বাকিদের আগ্রহ এক দিনেই শেষ। ২৬৯ জন সাংসদ একবারও গ্রন্থাগারে যাননি। দশম সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠক (চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি) থেকে ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রন্থাগারের নথি যাচাই করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গ্রন্থাগারের প্রতি সাংসদদের আগ্রহ নিয়ে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এর কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ সদস্য কোনো না-কোনো ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত এবং ব্যস্ততার কারণে তাঁদের পক্ষে গ্রস্থাগারে এসে পড়াশোনা করা সম্ভব হয় না।
‘জাতীয় সংসদের গ্রন্থাগার ব্যবহার: প্রেক্ষিত নবম জাতীয় সংসদ’ নামের গবেষণাটি করা হয়েছিল সংসদ সচিবালয় থেকেই। সেখানে বলা হয়েছে, অধিবেশন চলাকালে গ্রন্থাগারে সাংসদদের যাতায়াত বাড়ে। তবে রাষ্ট্রপতির ভাষণ ও বাজেট-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করতে বছরের প্রথম অধিবেশন ও বাজেট অধিবেশনে গ্রন্থাগারে সদস্যদের উপস্থিতি বেশি থাকে।
গবেষণাটি নবম সংসদের মাত্র ১৭ জন সাংসদকে নিয়ে করা হলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি দশম সংসদেও। কথাটা মেনেও নিলেন সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও লাইব্রেরি কমিটির সভাপতি ফজলে রাব্বী মিয়া। প্রথম আলোকে বলেন, মাত্র ১৭ জন সাংসদ নিয়ে গবেষণা করা হলেও বাস্তবতা এ-সম্পর্কিত প্রতিবেদনকে সমর্থনই করে। সাংসদদের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সংসদের ভেতরে জ্ঞানভিত্তিক চর্চা কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা গ্রন্থাগারে না বসে ব্যবসায়ে মনোযোগী থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। যে কারণে অনেক সাংসদের কাছে সংসদ ভবনের গ্রন্থাগারের অবস্থানও অজানা।
সংসদ গ্রন্থাগারে দুষ্প্রাপ্য কিছু বই আছে। যেমন: বঙ্গীয় আইন পরিষদ বিতর্ক ১৯৩৭-৪৬, গণপরিষদ বিতর্ক ১৯৭২, হাউস অব কমন্স বিতর্ক ১৮০৯-১৯৮০, পাকিস্তান গণপরিষদ বিতর্ক ১৯৪৭-১৯৫৯, অল ইন্ডিয়া রিপোর্টস ১৯১৪-৯৩, ইত্যাদি।
কিন্তু হিসাব নিয়ে দেখা গেছে, মাত্র ২৭ জন সাংসদ বই সংগ্রহ করেছেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী সংগ্রহ করেছেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী গীতবিতান, শওকত আলী ব্রিটানিকা এটলাস, এ কে এম মাঈদুল ইসলাম ইন্দিরা গান্ধী স্পিচেস ইন পার্লামেন্টসহ বেশ কিছু বই সংগ্রহ করেছেন।
সাংসদদের অনাগ্রহে গ্রন্থাগারের ভেতরের পরিবেশও দিন দিন নাজুক হয়ে উঠেছে। দেশের বেশির ভাগ বড় গ্রন্থাগারে কম্পিউটারের মাধ্যমে বই ও তথ্যের শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি (ই-ক্যাটালগিং) চালু হলেও সংসদ গ্রন্থাগার এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চলছে। দুর্বল শ্রেণিবিন্যাসের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বই খুঁজে পাওয়া যায় না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক-প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক এবং সংসদবিষয়ক গবেষক নিজাম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংসদ গ্রন্থাগারে সংসদবিষয়ক বই ও তথ্য-উপাত্ত থাকবে। পাঠক থাকবে এবং গবেষণার সুযোগ থাকবে। কিন্তু আমাদের সংসদ গ্রন্থাগারে বই থাকলেও পাঠক নেই। গবেষণাও হয় না। যে কারণে নতুন নতুন বই সংগ্রহ হয় না এবং যেসব বই আছে তার হদিসও পাওয়া যায় না।’
গ্রন্থাগার ব্যবহার করা ৮১ জন: গ্রন্থাগারের নথি অনুযায়ী, বর্তমান সংসদে সর্বোচ্চ ৬৩ দিন গ্রন্থাগার ব্যবহার করেছেন স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী। এ ছাড়া পঞ্চানন বিশ্বাস ৩০ দিন; আবদুল মজিদ খান ২০; নুরুল ইসলাম ১৬; সাবেক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ ১৫; হাবিবে মিল্লাত ১১, আমান উল্লাহ ও তালুকদার আবদুল খালেক ১০; খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ৯; সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী ও আবদুল মালেক ৮; মঈন উদ্দীন খান বাদল, কাজী রোজী ও ওয়াসিকা আয়েশা খান ৭; সাগুফতা ইয়াসমীন ৬; হুইপ মাববুব আরা, সাইমুম সরওয়ার ও ফরহাদ হোসেন ৫; ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক, আলতাফ আলী, ফজিলাতুন্নেসা (বাপ্পি) ও আমাতুল কিবরিয়া ৪; আবদুর রাজ্জাক, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক, ইসরাফিল আলম, হাফিজুর রহমান ও মাহজাবিন খালেদ ৩ এবং এ কে এম মাঈদুল ইসলাম, মীর শওকত আলী বাদশা, নাজমুল হক প্রধান, উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম, এ কে এম শাহজাহান কামাল, আবদুল মতিন ও ফজিলাতুন নেসা ২ দিন গ্রন্থাগারে গিয়েছেন।
এক দিনের জন্য গ্রন্থাগারে গেছেন এইচ এম এরশাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আবদুল মতিন খসরু, মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, আব্দুস শহীদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ, তাজুল ইসলাম, আবদুল হাই, এম এ মান্নান, জিয়াউল হক মৃধা, সিমিন হোসেন, এনামুল হক, গোলাম মোস্তফা, আলী আজম, পংকজ নাথ, মেহের আফরোজ, আবদুল মান্নান (বগুড়া-১), হুইপ ইকবালুর রহিম, ফরিদুল হক খান, জাহিদ আহসান, এস এম মোস্তফা রশিদী, ছবি বিশ্বাস, উষাতন তালুকদার, শামীম ওসমান, এনামুর রহমান, তারানা হালিম, ওয়ারেসাত হোসেন, নবী নেওয়াজ, আবু সালেহ মো. সাঈদ, রুহুল আমিন, শিবলী সাদিক, নুরুল ইসলাম তালুকদার, আবুল কালাম আজাদ, সেলিম উদ্দিন, মনিরুল ইসলাম, সালমা ইসলাম, মাহজাবিন মোরশেদ, নুরজাহান বেগম, মোস্তফা লুৎফুল্লাহ, শামসুন্নাহার বেগম, দিলারা বেগম, সেলিনা বেগম ও নাসিমা ফেরদৌসী।
গ্রন্থাগারের কর্মকর্তারা জানান, সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ সাংসদদের অনেকে অফিসের কর্মচারীদের মাধ্যমে বই ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেন। তবে সে সংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।
ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, ‘গ্রন্থাগারে যান না বলেই নতুন সাংসদদের সংসদীয় কর্মকাণ্ডে ভুল করতে দেখা যাচ্ছে। তবে আমরা গ্রন্থাগারকে আকর্ষণীয় করে সাজানোর পদক্ষেপ নিয়েছি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্থিক সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। আশা করা যায় ছয় মাসের মধ্যে গ্রন্থাগারে সাংসদদের উপস্থিতি তিন গুণ হবে।’