চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্কের মধ্যেই ২৪ শিক্ষক নিয়োগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ—কোনোটিতেই বিতর্ক আর অনিয়ম পিছু ছাড়ছে না। কয়েক দিন আগেই ফাঁস হয়েছে ‘নিয়োগ-বাণিজ্য’-এর ফোনালাপ। এবার সমালোচনার মুখেই ৮ বিভাগে ২৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শনিবার দুপুরে সিন্ডিকেটের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে নিয়োগ-বাণিজ্যের সুষ্ঠু তদন্ত করা এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের দাবিতে শনিবার রাত ৯টায় বিক্ষোভ মিছিল করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক পক্ষের নেতা-কর্মীরা।

বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সভায় ইংরেজি বিভাগে তিনজন, ফার্মাসিতে তিনজন, প্রাণিবিদ্যায় ছয়জন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একজন, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় একজন, অর্থনীতিতে পাঁচজন, ফলিত ও পরিবেশ রসায়নে তিনজন ও সমাজতত্ত্ব বিভাগে দুজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে ফারসি বিভাগের তিনটি পদে শিক্ষক নিয়োগে বোর্ডের সুপারিশ।

সিন্ডিকেটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন সদস্য এ তথ্য নিশ্চিত করে প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন আগে ফারসি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগটিতে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশ বাতিল করা হয়েছে। ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান শনিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সব প্রক্রিয়া যথাযথ মেনেই আট বিভাগে এই শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অর্থ লেনদেন নিয়ে পাঁচটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। এসব ফোনালাপ ছিল উপাচার্য শিরীণ আখতারের ব্যক্তিগত সহকারী খালেদ মিছবাহুল ও হিসাব নিয়ামক দপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেনের সঙ্গে দুজন নিয়োগ প্রার্থীর। ফোনালাপ ফাঁসের পর খালেদ মিছবাহুলকে উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয় আহমদ হোসেনকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ এবারই প্রথম নয়। গত বছরের জুনে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১২ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৫ জনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার পছন্দ, ছাত্রলীগের নেতা ও কয়েকজন শিক্ষকের সুপারিশে এসব নিয়োগ দেওয়া হয় বলে তখন অভিযোগ ওঠে।

শনিবার সিন্ডিকেটের সভায় ২৪ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হলেও বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে ছিলেন আরও ১৩ জন; যাঁদের নিয়োগে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিয়োগ বোর্ড সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সিন্ডিকেট সদস্যরা বাড়তি নিয়োগে অসম্মতি জানান। ফলে তাঁরা নিয়োগ পাননি। সিন্ডিকেটের দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্য জানান।

ফাঁস হওয়া ফোনালাপে যা ছিল

ফোনালাপে আহমদ হোসেন ফারসি বিভাগে শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহী প্রার্থীকে বলেন, ‘তৃতীয় শ্রেণির একটা চাকরির জন্য এখন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা লাগে। চতুর্থ শ্রেণির চাকরির জন্য লাগে ৮ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলো সর্বোচ্চ সম্মানিত পদ। এখানে ১৬ লাখের কম দিলে হবে না।’ আহমদ হোসেন আরও বলেন, ‘ম্যাডাম (উপাচার্য) যদি রাজি হন, তাহলে আপনি অর্ধেক পেমেন্ট করবেন এবং পেমেন্ট যে করছেন সেটার একটা চেক অথবা ডকুমেন্ট দিতে হবে। কিন্তু ম্যাডাম যদি ‘‘না’’ বলেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীও যদি ব্যক্তিগতভাবে সুপারিশ করেন, কোনো কাজ হবে না। এটাই শেষ কথা। কারণ, ম্যাডাম নিজেও তো আসছেন অনেক টাকা খরচ করে। এখন আপনার যদি সম্মতি থাকে এবং ম্যাডাম যদি রাজি হন, তাহলে একটা কন্ট্রাক্ট (চুক্তি) করা যায়।’

উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী খালেদ মিছবাহুল নিয়োগপ্রার্থীকে উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনায় বসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রার্থীকে বলেছিলেন, ‘তুমি চট্টগ্রামের মানুষ বলেই তোমাকে আমি টান দিলাম। উপাচার্যকে তোমার কথা বলব। তিনি যেভাবে বলবেন, সেভাবে হবে।’

উপাচার্য বললেন, সব ষড়যন্ত্র

সিন্ডিকেটের সভা শেষে সন্ধ্যায় নগরের চারুকলা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করেছেন উপাচার্য শিরীণ আখতার। ফোনালাপের বিষয়টি জেনে গত ৯ জানুয়ারি হাটহাজারী থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয় জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তাঁর ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

ছাত্রলীগের বিক্ষোভ

নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্ত করা এবং ২৪ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের দাবিতে ক্যাম্পাসে রাতে মিছিল করেন ছাত্রলীগের ভার্সিটি এক্সপ্রেস (ভিএক্স) পক্ষের অনুসারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রলীগের রাজনীতি দুই পক্ষে বিভক্ত। এক পক্ষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সমর্থক। অন্য পক্ষ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী। ভিএক্স পক্ষটি নাছিরের অনুসারী।

ভিএক্সের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। বিভিন্ন বিভাগে টাকা দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। সব কটি নিয়োগ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। যত দিন নিয়োগ বাতিল করা হবে না, তত দিন ক্যাম্পাস অবরুদ্ধ থাকবে। তবে তাঁর এ বক্তব্যের কিছু সময় পর অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।

ছাত্রলীগের দাবি প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনটির এক নেতা নিয়োগ না পাওয়ায় তাঁরা কর্মসূচি পালন করছেন। বিষয়টি দেখা হচ্ছে।