২৫ মার্চ দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াসার পানি আর ইলেকট্রিসিটি বন্ধ। রাতে হারিকেন, মোমবাতি জ্বালিয়ে কাটিয়ে দিই কোনোমতে। কিন্তু পানির কষ্ট সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করল। আমার বাড়ির পেছনে হিন্দু জমিদার কেদারনাথ তেওয়াড়ীর টিউবওয়েলটাই এখন এ পাড়ার লোকদের পিপাসা নিবারণের একমাত্র সম্বল।
বেলা প্রায় ১১টা। দুপুরের রান্না শেষ। বাচ্চাদের তাড়া দিলাম গোসল করতে। নিজেও একফাঁকে সেরে নিয়েছি গোসল। আবার উপন্যাসটা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালাম জানালায়। পড়তেও ইচ্ছা করছে না। হঠাৎ অনেকগুলো বুটের খটাখট শব্দে চমকে তাকালাম বাইরে। দেখলাম, আমার বাড়ির বাঁ পাশের গলি থেকে ছয়–সাতজন সৈন্য স্টেনগান হাতে মকবুল সওদাগরের রুটির দোকানের দিকে দৌড়ে গেল এবং পাশের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে গেল দোতলায়। দোকানের ওপরে থাকে বম্বেওয়ালা ভাড়াটে সাইফী সাহেব। তাঁর ঘরের ভেতর দিয়ে বারান্দায় এসে আমার বাড়ির দিকে স্টেনগান উঁচিয়ে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু ভাবার আগেই একটা জিপ আর একটা লরি এসে থামল আমার বাড়ির সামনে। টপাটপ লাফিয়ে নামল ৪০–৫০ জন। বুঝতে বাকি রইল না ওদের শিকার এখন আমরা। তবু সাহস হারালে তো চলবে না। প্রাণপণ শক্তিতে ছুটে এলাম এ ঘরে। ডা. শফীকে খুঁজছি।
কে যেন প্রশ্ন করল, ‘কী, অমন করছেন কেন?’ বললাম, মিলিটারি—মিলিটারি এসেছে আমার বাসায়। কথা শেষ হলো না, একনাগাড়ে গুলির শব্দ। সঙ্গে দমাদম ড্রয়িংরুমের দরজার ওপর আঘাত। বাধা দেওয়ার আগেই ডা. শফী ছুটে গেল ড্রয়িংরুমে এবং নিজেই দরজা খুলল। অমনি হুড়মুড় করে ১৫–২০ জন ঢুকে পড়ে ছড়িয়ে গেল এঘরে–ওঘরে। বাচ্চারা সব ড্রেসিংরুমে ঢুকে ভয়ে জড়সড় হয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আমার সেসব দিকে লক্ষ নেই, লক্ষ শুধু আমার স্বামী ডা. শফীর দিকে। ঢুকেই একজন প্রশ্ন করল, ‘ডা. শফী কৌন?’ সঙ্গে সঙ্গেই ও জবাব দিল।
ওকে দাঁড় করিয়ে রাখল ড্রয়িংরুমে। তিনজন থাকল ওর পাহারায়। বাকিরা সব এঘর–ওঘর করে সারা বাড়ি নিমেষেই তছনছ করে ফেলল। একজন বলল, আলমারি খোলো। চাবি হাতেই ছিল। বলামাত্রই খুলে দিলাম।
ডা. শফীকে নিয়ে আমার বাড়ির পেছনে তেওয়াড়ীবাবুর বাড়ির দিকে যাচ্ছে। আঁতকে উঠলাম—একি! ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমার প্রশ্নের কেউ জবাব দিল না। বাড়ির ভেতর তখনো কিছু সৈন্য তল্লাশির অজুহাতে এঘর–ওঘর ঘুরছে আর বিশ্রীভাবে মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছে। জিন্নু, রানু, মিনু আপা সবাই মাথায় ঘোমটা টেনে জোরে জোরে কলমা পড়ছে আর অসহায় চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমার সেসবে লক্ষ দেওয়ার সময় নেই। আমি পাগলের মতো ছুটে গেলাম ড্রয়িংরুমের জানালার কাছে, কিন্তু দেখতে পেলাম না ওকে। দেখলাম পাশেই লক্ষপতি বিহারি ব্যবসায়ী পি এ আনছারীর প্রকাণ্ড দোতলা ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দাতেও মিলিটারিরা মেশিনগান হাতে আমার বাড়ির দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।
একেবারে ডান দিকে রাস্তার ওপর যে ফ্ল্যাটটা, তাতে থাকে এক বাঙালি ব্যবসায়ী, নাম ইস্রাফিল। দেখলাম ওর সিঁড়ি বেয়ে উঠছে দুজন সৈন্য, ওদের পোষা কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠতেই একজন বিরক্ত হয়ে গুলি করে স্তব্ধ করল কুকুরটাকে। তারপর হাসতে হাসতে উঠে গেল ওপরে। এ সময় মনে হলো আমার ভাই এহসানকে দেখছি না। ও কোথায়? বুকটা আরেকবার কেঁপে উঠল। কোনোমতে টলতে টলতে ওর রুমে এলাম। দেখি, ও দুহাত মুঠো করে পশ্চিম দিকে মুখ করে কী এক দোয়া নিবিষ্ট মনে বিড়বিড় করে পড়ছে। এহসানকে বললাম, তোর দুলাভাইকে ওরা কেদারবাবুর বাড়ির দিকে নিয়ে গেছে। ও শান্তস্বরে বলল, আপা, শান্ত হন। বিপদে ধৈর্য হারাতে নেই।
গেটে দাঁড়ানো জিপটা স্টার্ট নেওয়ার শব্দ হলো। যে কজন বাড়ির ভেতর ছিল, হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল সবাই। ডা. শফী তখনো আসেনি ঘরে। আমি ছুটলাম আমার দোতলার ডান পাশের ফ্ল্যাটে। কেদারবাবুর বাড়ির কম্পাউন্ড দেখা যায়। ওরা সবাই পালিয়ে গেছে ভারতে। শুধু মন্দিরে একজন বুড়ো পুরোহিত ছিল। বয়স আশির ওপর। ওপরে গিয়েই দেখি বুড়ো পুরোহিত ঠাকুর একজন সৈন্যের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সে প্রচণ্ড এক লাথি মেরে তাকে ছিটকে ফেলল এবং আরেকজন গুলি করল। বুড়ো পুরোহিত কিছুক্ষণ ছটফট করে শান্ত হলো। আমি দুহাতে মুখ ঢেকে আর্তনাদ করে উঠলাম। কিন্তু পরক্ষণে চোখ থেকে হাত সরিয়ে খুঁজলাম ডা. শফীকে। দেখলাম, তিন–চারজন সেনা হাসতে হাসতে গেট পেরিয়ে আসছে, সঙ্গে ডা. শফী। ডা. শফীর মুখটা রক্তশূন্য কাগজের মতো সাদা মনে হলো। একটু পরেই ডা. শফীকে নিয়ে জিপটা শব্দ তুলে অদৃশ্য হলো। (সংক্ষেপিত)
সূত্র: স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন, বেগম মুশতারী শফী, প্রিয়ম প্রকাশনী, ১৯৮৯
বেগম মুশতারী শফী: শহীদজায়া
(১৯৩৮–২০২১)