চাল ব্যবসায় অভিজ্ঞ মন্ত্রী দাম কমাতে পারছেন না
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সময়ে মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ২৮%। নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না তিনি।
মোটা চালের গড় দাম
২০১৯ ৪০ টাকা
২০২০ ৪৮ টাকা
সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে এখন মোটা চালের কেজি ৪৭-৫৫ টাকা।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চালের ব্যবসায় অভিজ্ঞ। কিন্তু চালের দাম নিয়ন্ত্রণে তিনি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। ফলে ভালো ফলন ও আমদানির পরও দেশের প্রধান এই খাদ্যের দাম বাড়ছে, যা করোনাকালে সংকটে থাকা মানুষের কষ্ট বাড়িয়েছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে সাধন চন্দ্র মজুমদার যেদিন (৭ জানুয়ারি ২০১৯) শপথ নেন, সেদিন ঢাকার বাজারে মোটা চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। গতকাল বুধবার তা দাঁড়ায় ৪৭ থেকে ৫৫ টাকায়। ফলে মন্ত্রীর আড়াই বছরের মেয়াদে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৯ থেকে ১৩ টাকা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। একইভাবে বেড়েছে মাঝারি ও সরু চালের দাম। এটা শুধু যে মৌসুমি ওঠানামা, তা নয়; বরং বছর বছর চালের গড় দামই বেড়ে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০১৯ সালে দেশে মোটা চালের গড় দাম ছিল ৪০ টাকা, ২০২০ সালে তা বেড়ে ৪৮ টাকা হয়। পাঁচজনের একটি নিম্ন আয়ের পরিবারে এতে ৩৬০ টাকার মতো ব্যয় বেড়ে যায় (দৈনিক দেড় কেজি চাহিদা ধরে)।
এবার বাজারের অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষণীয়। সাধারণত বোরো মৌসুম এলে চালের দাম কমে। ২০২০ সালজুড়ে বেশি দামে চাল কেনা মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন বোরো মৌসুমের। তবে এবার এপ্রিল-মে মাসে বোরো ধান ওঠার পরও চালের দাম তেমন একটা কমেনি; বরং মৌসুম শেষ না হতেই বাড়তে শুরু করে। এখনো বাড়ছে।
টিসিবি বলছে, ঢাকায় গত এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৬ শতাংশের মতো। রাজধানীর ছোট বাজার ও পাড়া-মহল্লার মুদিদোকানে এখন ভালো মানের এক কেজি মোটা চাল কিনতে ৫০ টাকা লাগে। এর চেয়ে কিছুটা কম দামে চাল পাওয়া যায় বড় বাজারে এবং বেশি পরিমাণে কিনলে।
বাজারে এখন মাঝারি বিআর-২৮ ও সমজাতীয় চালের প্রতি কেজি দর মানভেদে ৫২ থেকে ৫৭ টাকা। মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো সাধারণত বিভিন্ন সুপরিচিত চালকলে উৎপাদিত মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল কেনে, যা প্রতি কেজি ৬২ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
চালের এই দাম ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ। ওই বছর হাওরে আগাম পানি এসে যাওয়া ও বন্যার কারণে বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন কম হয়েছিল। এখন দামও বেশি, আবার করোনার আঘাতে মানুষের আয়-রোজগারে টান পড়েছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে গত সপ্তাহে চাল কিনতে যাওয়া অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘সরকার কি কিছুই দেখে না? কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।’
মন্ত্রীর চাল ব্যবসার অভিজ্ঞতা
বীর মুক্তিযোদ্ধা সাধন চন্দ্র মজুমদার তাঁর এলাকায় একজন সজ্জন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিবিদ এক সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরে সাংসদ হয়েছেন। নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর-পোরশা-সাপাহার) আসনে পরপর তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁকে মন্ত্রিসভায় আনা হয়, দেওয়া হয় খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। সে সময় এই আলোচনা ছিল যে মন্ত্রীর নিজের চাল ব্যবসার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি চালের বাজার ভালো বুঝবেন, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
নওগাঁর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাধন চন্দ্র মজুমদার ১৯৭২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সরাসরি ধান-চালের ব্যবসা করেছেন। নির্বাচনী হলফনামা ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া মন্ত্রীর জীবনবৃত্তান্তে কৃষি ব্যবসার কথা বলা হয়েছে। তিনি নিজেও চাল ব্যবসার অভিজ্ঞতার কথা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। বলেছেন, এখন তাঁদের পারিবারিক ধান-চালের ব্যবসা দেখাশোনা করেন তাঁর চাচাতো ভাই মুরালী মোহন মজুমদারের ছেলে দেবব্রত মজুমদার।
চালের দাম নিয়ে সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে দেশে চালের দাম অনেক কমে গিয়েছিল। ফলে কৃষকেরা লোকসানের মধ্যে পড়ে যান। দাম কিছুটা বাড়ায় কৃষকেরা সুফল পাচ্ছেন।’
অবশ্য অভিযোগ আছে, কৃষকেরা এই বাড়তি দামের সামান্যই পান। সুফল ভোগ করেন মূলত ব্যবসায়ী ও মিলমালিকেরা।
দেশে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চালের দাম সবচেয়ে বেশি থাকে। এবার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগেভাগে পদক্ষেপ নিতে হবে।এম আসাদুজ্জামান, সাবেক গবেষণা পরিচালক, বিআইডিএস।
নিয়ন্ত্রণে ‘অসফল’
করোনার বছর ২০২০ সালের চালের দাম দেশের মানুষকে বেশি ভুগিয়েছে। এ সময়ে খাদ্যমন্ত্রী চাল আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, কাজে আসেনি। খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে গত সেপ্টেম্বরে দামও বেঁধে দিয়েছিল, তেমন সুফল পাওয়া যায়নি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গত বছরের আগস্ট মাসেই চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় আমদানির প্রক্রিয়া শেষ করতে দেরি করে। বেশির ভাগটা আসে ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে। তখন আবার বোরো মৌসুম ঘনিয়ে আসে। তা নিয়েও সমালোচনা হয়।
মৌসুমের সময় সরকারিভাবে চাল কেনা ও চালের মজুত ব্যবস্থাপনায়ও সাফল্য দেখাতে পারেননি মন্ত্রী। গত বছরের এপ্রিল মাসে সরকারি গুদামে চালের মজুত তিন লাখ টনে নেমে গিয়েছিল, যা ছিল ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পর্যাপ্ত চাল না থাকায় সরকার করোনার মধ্যেও খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচির পরিসর বিস্তৃত করতে পারেনি। ২০২০-২১ অর্থবছরে খাদ্য অধিদপ্তর বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে বিতরণ করেছে ১৭ লাখ ৬৯ হাজার টন চাল, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সোয়া তিন লাখ টন কম। অথচ এ সময়েই সরকারি কম দামের চাল কিনতে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন।
বাজারে ‘নব্য মজুতদার’
এবার চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে খাদ্যমন্ত্রী, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও চালকল মালিক সমিতির নেতারা একযোগে ‘নব্য মজুতদারদের’ দায়ী করছেন। সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে অন্য ব্যবসায় মন্দাভাব চলছে। অনেক ব্যবসায়ী এখন নগদ টাকা ধান-চাল মজুতে বিনিয়োগ করছেন। সমাজের নানা পেশার মানুষও চালের মজুত গড়ে তুলেছেন। যে কারণে দাম কিছুটা বাড়তে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে দেওয়া এক বক্তব্যে একই ধরনের মন্তব্য করেন। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে অন্য কেউ মজুত করছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ৪ আগস্ট চালকলমালিকদের একটি বৈঠক হয়। সেখানেও চালকলমালিকেরা ‘নব্য মজুতদারদের’ কারণে ধান-চালের দাম বাড়ছে বলে অভিযোগ করেন। তাঁরা সরকারকে এসব মজুতদারকে খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে অনেক ধান মজুতদার ঢুকে পড়েছে। তাদের কারণে দাম বাড়তে পারে। তবে চাল আমদানির সুযোগ দিলে দাম নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।’
সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, নব্য মজুতদারদের রুখবে কে?
আবারও আমদানি
বাজার সামাল দিতে আবারও বেসরকারি খাতকে চাল আমদানির অনুমোদন দিচ্ছে সরকার। আমদানির জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় চালে মোট করভার সাড়ে ৬২ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। চলতি বছরের শুরুতেও এভাবে শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ওই প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে গেছে। সূত্র আরও জানায়, প্রাথমিকভাবে বেসরকারি খাতকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। শুল্ক কমানোর বিষয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীভাবে চালের দাম বাড়ে, আর তা কীভাবে কমানো যায়, তা আমাদের খাদ্যমন্ত্রীর ভালো জানার কথা। তিনি কি অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলেন, নাকি সরকারি ব্যবস্থাদি ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেন না, তা পরিষ্কার নয়।’ তিনি বলেন, দেশে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চালের দাম সবচেয়ে বেশি থাকে। এবার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগেভাগে পদক্ষেপ নিতে হবে।