গোলটেবিল বৈঠক
চা–শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে হবে উন্নয়নের মূলধারায়
চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন ও নির্দেশনা জরুরি।
নিরাপদ পানি ও পয়োব্যবস্থার ক্ষেত্রে চা-শ্রমিকেরা সমাজের মূলধারার চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে। মজুরি কম বলে বিচ্ছিন্ন ও প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর জীবনমানও অনুন্নত। অথচ চা-শ্রমিকদের বাদ রেখে টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব নয়। তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের প্রতিশ্রুতি আছে, কাজও হচ্ছে। তবে সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগে সব স্তরে কাজ করতে হবে।
‘নিরাপদ পানীয় জল ও স্যানিটেশন (এসডিজি ৬): চা-শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা। এ বৈঠকের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটারএইড ও প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ওয়াটার অ্যালায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল ও উন্নয়ন সংস্থা সিমাভি। গতকাল সোমবার ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে আলোচকেরা বলেন, পিছিয়ে থাকা চা-শ্রমিকদের উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন ও নির্দেশনা জরুরি। এ কাজে চা-বাগান মালিকপক্ষ, চা-শ্রমিক ইউনিয়ন, স্থানীয় পঞ্চায়েত চা বোর্ড, বেসরকারি সংস্থা এবং সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও বাণিজ্য) ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, সারা দেশে ১৬৭টি চা-বাগান আছে। এখানে প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যার ৫১ শতাংশই নারী। এই শ্রমিকদের পোষ্য আছে আরও পাঁচ লাখ মানুষ। চা-শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিশুসদন এবং শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা—এই চার পরিমাপক নিয়ে সরকারের কাজ চলছে।
ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অবশ্যই চা-শ্রমিকদের নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার, মালিকপক্ষ, স্থানীয় সরকার, চা বোর্ড, শ্রমিক—সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে।
দারিদ্র্যের বৃত্তে আটকে আছে চা-শ্রমিকের জীবন উল্লেখ করে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও ওয়াটারএইড বাংলাদেশের পলিসি অ্যাডভাইজার মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, চা-বাগানের শিশুরা অপুষ্টির কারণে খর্বাকৃতির হয়। সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপদ পানি, পয়োব্যবস্থায় সরকারের আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
উন্নয়ন সংস্থা সিমাভির ওয়াশ অ্যালায়েন্স ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর অলক কুমার মজুমদার বলেন, সম্প্রতি চা-বাগান নিয়ে এক জরিপে দেখা গেছে, তিন ভাগ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছেন। নিরাপদ পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ব্যবহার করতে পারছেন ৩ দশমিক ৮ ভাগ মানুষ। ৯৫ ভাগ নারী মাসিক ব্যবস্থাপনায় নোংরা কাপড় ব্যবহার করেন।
আইন মানা না হলে চা-শ্রমিকদের সমস্যাগুলো থেকেই যাবে বলে মনে করেন কমলগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী। তিনি বলেন, স্যানিটেশন বা নিরাপদ পানি নিয়ে চা-বাগানে যেসব উন্নয়ন সংস্থার কাজ হচ্ছে, তা প্রকল্প শেষ হলেই ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মিতালী দত্ত বলেন, চা-শ্রমিকেরা এখনো খোলা জায়গায় মলত্যাগ করেন। তাঁদের আবাসনও নড়বড়ে। নারী শ্রমিকেরা এতটাই অসচ্ছল যে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার টাকা থাকে না। ফলে তাঁরা জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকিতে আছেন। চা-শ্রমিকদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে নিয়মিত বাগান পরিদর্শন করার পরামর্শ দেন তিনি।
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যাফেয়ার্স (আইডিয়া) সিলেটের নির্বাহী পরিচালক নজমুল হক বলেন, চা-বাগানের শিশুরা শিক্ষা-স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে পিছিয়ে। কর্তৃপক্ষ কতটুকু এসব নিশ্চিত করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আবার চা-বাগানের মানুষও সচেতনতার সামাজিক আন্দোলনে খুব একটা নেই।
সিটি গ্রুপ টি এস্টেটের মহাব্যবস্থাপক সেজাদ সারোয়ার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চা-শ্রমিকদের শিক্ষা, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, নিরাপদ পানির ব্যবস্থায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সরকার ও উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে আমরা কাজ করতে আগ্রহী। একসঙ্গে কাজ করলে এখানে অবহেলা থাকবে না।’
চা-শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে মূল সমস্যা মজুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রাজু গোয়ালা। তিনি বলেন, মজুরির সঙ্গে জীবনমান সরাসরি সম্পর্কিত। দারিদ্র্যের কারণেই বাকি সমস্যাগুলো হচ্ছে। চা-শ্রমিকেরাও আর পিছিয়ে থাকতে চান না। রেশনে যে আটা ও চাল দেওয়া হয়, তা অনেক সময় খাওয়ার অনুপযোগী।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ওয়াটারএইড বাংলাদেশের পলিসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর পার্থ হেফাজ সেখ বলেন, চা-শ্রমিকদের যে আয়, তা দিয়ে নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নিশ্চিত করা কঠিন।
ওয়াটারএইড বাংলাদেশের অ্যাডভোকেসি স্পেশালিস্ট রঞ্জন কুমার ঘোষ বলেন, ২০১০ সালে জাতিসংঘ নিরাপদ পানীয় জল ও স্যানিটেশনকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। আর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় সরকারের ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য টেকসই ও মানসম্পন্ন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্য আছে।
বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।