ছোট কাটারার প্রতিষ্ঠানটি আসলে অনেক বড়

তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ ৯০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। দেশীয় চিকিৎসার প্রসারে কলেজটির ভূমিকা বড়।

ঢাকা শহরের বকশীবাজারের উমেশ দত্ত রোডে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ। ইউনানি চিকিৎসা ও শিক্ষার এই ভবনটি নতুন। তবে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৯০ বছর আগে, ১৯৩০ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হেকিম হাবিবুর রহমান।

পুরান ঢাকার ছোট কাটারার হাবিবুর রহমান ১৩ বছর বয়সে শিক্ষার জন্য অবিভক্ত ভারতের কানপুরে দারুল উলুম মাদ্রাসায় গিয়েছিলেন। ওই মাদ্রাসায় ইউনানি বা তিব্ব শিক্ষা শেষে তিনি প্রথমে লক্ষ্ণৌ, পরে দিল্লি এবং এরপর আগ্রা যান চিকিৎসাবিদ্যা অর্জনের জন্য। বিদ্যা অর্জন শেষে ১১ বছর পর ফিরে আসেন ঢাকায়। তখন তিনি চিকিৎসক, তিনি হেকিম। নিজ বাড়িতে দাওয়াখানা খুলে চিকিৎসা শুরু করেন। হাবিবুর রহমানের নাম ছড়িয়ে পড়ে। সেই খ্যাতি আজও আছে। পুরান ঢাকার ছোট কাটারায় তাঁর নামে সড়ক আছে।

হেকিম হাবিবুর রহমান মানুষকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। সরকারের কাছ থেকে সহায়তা না পেয়ে নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠান করেন পূর্ব ভারতের প্রথম ইউনানি কলেজ তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ। এর জন্য নিজের একটি বড় বাড়ি তিনি দান করেন।

এক শ বছর আগের সেই দাওয়াখানা, প্রথম গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান ভবনও নেই। তবে সেই জায়গায় গড়ে ওঠা একটি ভবনে কথা হয় হেকিম হাবিবুর রহমানের নাতি গবেষক সাদ উর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকার একটা ঐতিহ্য ছিল বাড়ির উঠানে নিম ও ছাদে তুলসীগাছ লাগানোর। ও দুটি ঔষধি গাছ।’ তিনি বলেন, ওই ঐতিহ্য গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর দাদার অবদান ছিল।

ইতিহাসের অংশ

হেকিম হাবিবুর রহমান

১৯৩০ সালে আটজন ছাত্র ও দুজন শিক্ষক নিয়ে তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে এটিই ঢাকার প্রথম ও একমাত্র হেকিমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা ও শিক্ষার প্রসার ঘটে। আজ পর্যন্ত সব সময় অ্যালোপ্যাথি রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছে। ইউনানি, আয়ুর্বেদি চিকিৎসা ও শিক্ষা তা পায়নি। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় ইউনানি কলেজ গড়ে তোলা ছিল বড় ঘটনা। এই কলেজকে ঘিরে দেশীয় চিকিৎসাপদ্ধতি প্রতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়ার নতুন সুযোগ পায়। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশে আরও অনেক কলেজ গড়ে ওঠে। এসব কলেজ গড়ে ওঠা, শিক্ষক তৈরি করা, পাঠ্যক্রম তৈরিতে তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজের ভূমিকা ছিল অনেক বড়।

এ অঞ্চলের হেকিমদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজটিও শুরু হয়েছিল এখান থেকে। হেকিম হাবিবুর রহমান ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আঞ্জুমানে আতিব্বায়ে বাঙ্গাল ওয়া আসাম বা বাংলা ও আসামের ইউনানি মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন। এই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে অবিভক্ত বাংলায় ‘স্টেট ফ্যাক্টি অব ইউনানি মেডিসিন’ গঠিত হয়। দেশের নাম করা হেকিমরা এর সদস্য ছিলেন।

এসব উদ্যোগের বাইরে ইউনানি চিকিৎসাবিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। কলেজ থেকে শেফা নামে একটি পত্রিকা বের করা হতো। এটা ছিল খুবই ব্যতিক্রমধর্মী ও সাহসী উদ্যোগ।

কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, গত শতকের সত্তরের দশকে এখানে বছরে চার–পাঁচজন করে শিক্ষার্থী ভর্তি হতেন, এখন ৬০–৭০ জন ভর্তি হচ্ছেন। চার বছরের কোর্সে মোট ২১টি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। বেসরকারি এই কলেজ চলে সরকারি কিছু সহায়তায় এবং কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনুদানে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নেওয়া হেকিমদের এখন প্রায় সারা দেশে দেখা যায়।

আছে আস্থা, আছে বিশ্বাস

কলেজ ভবনের নিচতলায় বড় ডিসপেন্সারি চোখে পড়ে। এখানে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ জন মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। এঁদের একটি বড় অংশকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার রীতি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ছিল।

তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ থেকে সামান্য দূরত্বেই দেশের সবচেয়ে বড় মেডিকেল কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ। সেটা থাকতে এখানে কারা চিকিৎসা নিতে আসেন, কেন আসেন—এই প্রশ্নের উত্তরে কলেজের অধ্যক্ষ ও অন্যান্য শিক্ষকেরা বলেছেন, এখনো মানুষের আস্থা আছে, বিশ্বাস আছে ইউনানি চিকিৎসার প্রতি।

তাঁরা বলেছেন, কিছু রোগী দীর্ঘদিন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার পরও আরোগ্য লাভ করতে পারেন না, তাঁরা এখানে আসেন। তাঁরা বলেছেন, সোরিওসিস (ত্বকের রোগ) এবং শ্বেতির চিকিৎসা তাঁরা ভালো করেন। এই দুটি রোগ অ্যালোপ্যাথিতে সুফল পেতে দেখা যায় না। দুটি রোগ নিয়ে এখানে অনেকেই আসেন। আবার অনেকে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার জটিল ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা এড়াতে চান। এই মহামারিকালে অনেকে আদার রস বা গরম পানি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এগুলো ইউনানি চিকিৎসার অংশ। সারা দেশে ঔষধি গাছের বাগান করার যে উৎসাহ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে , যে উৎসাহে সরকারেও সায় আছে—তার পেছনে আছে ইউনানি চিকিৎসকদের উদ্যোগ ও আগ্রহ।

কলেজের অধ্যক্ষ হেকিম মাহবুবুর রহমান বলেন, আদিকাল থেকে মানুষ গাছগাছড়ার ঔষধি গুণের ওপর নির্ভর করে এসেছে। এটাই ছিল মূল চিকিৎসা। এই চিকিৎসা সহজ, এই চিকিৎসা স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায়।