চারপাশে তখনো আলো ছড়ায়নি। কেবলই ফজরের আজানের ধ্বনি বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে। আমাদের গাড়ি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছাল। একসময় ওখানে মাস্টারি করেছি। তাই গলিঘুপচি সব জানা। প্রশাসনিক ভবনের কাছে গাড়ি রেখে সোজা ছুটলাম গগনশিরীষগাছটার নিচে। পৌঁছাতেই যে ডাকটি শুনলাম, সেটাই যে সদ্য আবিষ্কৃত নতুন প্রজাতির প্যাঁচাটির, তা বুঝতে কষ্ট হলো না। কারণ, ডাকটা আমাদের বনবাদাড় ও চা–বাগানের ডোরা কালিপ্যাঁচা বা এশিয়ান বার্ড জাঙ্গল আউলেটের কাছাকাছি, তারই কোনো দোসরের।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগে আমাদের ছাত্রের ছাত্র এখন অধ্যাপক এ এম সালেহ রেজা গত অক্টোবরের মাঝামাঝি প্যাঁচাটিকে প্রথম সেখানে আবিষ্কার করেন। বাংলাদেশে প্রজাতিটির এই প্রথম দর্শন। ২০১৫ সালে প্রকাশিত চেকলিস্ট অব ওয়াইল্ডলাইফ অব বাংলাদেশ বইয়ে অবশ্য আমি এটির বিষয়ে তথ্য দিয়েছি। এর বাংলা নাম দিয়েছি ‘ছোট কালিপ্যাঁচা’। এটির প্রাণিজগতীয় নাম Glaucidium radiatum। এর উপপ্রজাতি দুটি—একটি গ্লাসিডিয়াম রেডিয়াটাম, যার বিস্তার সারা ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের কিছু অংশে; আরেকটি গ্লাসিডিয়াম রেডিয়াটাম মালাবেরিকাম, যার বিস্তার শুধু দাক্ষিণাত্যের কেরালা ও তামিলনাড়ুতে।
প্যাঁচাটির অবস্থান বের করতে সামান্য সময় লাগল। ততক্ষণে গগনশিরীষের পথে প্রাতভ্র৴মণকারীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। লম্বা হয়ে গেছে দেশের নানা কোণ থেকে আসা পাখির শৌখিন আলোকচিত্রীর লাইন।
মোটামুটি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সুন্দর সুন্দর ডিজিটাল ক্যামেরা ও লেন্স পাওয়া যায় বলে অনেকেই এখন পশুপাখির ছবি তুলছেন। সেসব ছবি গবেষক ও বিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজে লাগানোর সুযোগ এসেছে। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। তবে মনে রাখা দরকার, খুব কাছে থেকে ছবি তোলার প্রবণতা মঙ্গলজনক নয়।
যাহোক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছোট কালিপ্যাঁচার হাজির হওয়ার ঘটনা বিরল বৈকি! তথ্যমতে, এগুলোর বিস্তার রাজশাহীর অদূরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পথ ভুলে এখানে এটি হাজির হয়েছে।
ছোট কালিপ্যাঁচা মূলত নিশাচর। অন্য সব প্যাঁচার মতো এটিও সারা রাত জেগে খাবার জোগাড় বা বিশ্রাম নিতে পারে। রাতের প্রহরে প্রহরে ডাকা কালিপ্যাঁচার সহজাতপ্রবণতা। এই প্যাঁচার বেলায়ও তা বেশ দেখা গেছে।
কালিপ্যাঁচা অতিপরিচিত কোটরে বা খুঁড়োলে প্যাঁচার চেয়ে বেশ ছোট, লম্বায় মোটে ২০ সেন্টিমিটার। পিঠের দিক লালচে বা গাঢ় বাদামি। সারা গায়ের পালকের ওপর মিহি পাথালি অসংখ্য সাদা দাগ। গলা ও বুকের মাঝখান থেকে পিঠের চেয়ে অপেক্ষাকৃত মোটা ও লম্বা সাদা রেখা কাঁধের দিকে চলে গেছে। বুক থেকে পেট বরাবর খাড়া সাদা মোটা দাগ চোখে পড়ে। চোখ জ্বলজ্বলে হলুদ, ঠোঁট সবুজাভ-হলুদ, হলুদাভ পা, আঙুল নরম পালকযুক্ত আর নখ কালো।
কালিপ্যাঁচার ডাক অনেকটা ছন্দোবদ্ধ। বার্ড জাঙ্গল আউলেটের মতো কর্কশ নয়। সূর্য ডোবার আগে থেকে ডাকে। ভোরে বেশি ডাকাডাকি করে। আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় গগনশিরীষের মগডাল, নয়তো অন্য পাখির ফোঁকল। শুনেছি আমগাছেও কখনো কখনো আশ্রয় নেয়। ঝুঁটি শালিকের সঙ্গে গর্ত নিয়ে ঝগড়া করে একে হেরে যেতে দেখেছি।
ছোট কালিপ্যাঁচার সারা দিনের মূল কাজ ঘুমানো, ঝিমানো, রোদ পোহানো, স্থান পরিবর্তন করা ও ক্বচিৎ ডাকাডাকি। অবস্থাদৃষ্টে বিশেষ করে ডাক থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গগনশিরীষগাছের পাখিটি একটি পুরুষ প্যাঁচা। এখন এর একটি সঙ্গিনী জুটলে ষোলোকলা পূর্ণ হবে।