চারতলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণের জানালার পাশে অনেকগুলো পোড়া মরদেহ দেখে বুক কেঁপে উঠেছিল স্বেচ্ছাসেবী রোজিনা খাতুনের। পোড়া মরদেহ দেখে কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। একজন নারীর পুড়ে যাওয়া মুখাবয়ব এখনো চোখে ভাসছে রোজিনার।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপের পুড়ে যাওয়া হাসেম ফুডস লিমিটেড কারখানায় উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিয়েছেন রোজিনা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহুদিন থেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছি। তবে হাসেম ফুডসের কারখানার চারতলায় পুড়ে অঙ্গার হওয়া এতগুলো মানুষের মৃতদেহ দেখিনি। পোড়া মানুষগুলো নারী না পুরুষ, তাও চেনার কোনো উপায় নেই। পুড়ে অঙ্গার হওয়া পা মৃতদেহের পাশে পড়ে ছিল।’

ভবন থেকে লাশ উদ্ধারের পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে বাইরে আনছেন স্বেচ্ছাসেবী রোজিনা খাতুন।
ছবি: আসাদুজ্জামান

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপের হাসেম ফুডস কারখানায় ভয়াবহ আগুন লাগে। সেদিন আগুন থেকে বাঁচতে অনেকে ছয়তলা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন। ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজন শ্রমিক মারা যান।

কারখানার আগুন ২০ ঘণ্টা চেষ্টার পর নিয়ন্ত্রণে আসে। ভবন থেকে একে একে ৪৯টি মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। আর এই উদ্ধার তৎপরতায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন রোজিনা খাতুনসহ ছয়জন স্বেচ্ছাসেবী।

ছয় স্বেচ্ছাসেবী খুব কাছ থেকে পুড়ে যাওয়া মরদেহগুলো পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে একে ভবন থেকে ৪৯ জনের লাশ বের করে আনেন।

এত পোড়া দেহ দেখেননি তাঁরা

২৫ বছর বয়সী যুবক আনোয়ার রানা বহুদিন থেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে আসছেন। হাসেম ফুডস কারখানায় আগুন লাগার খবর পেয়ে গতকাল শুক্রবার সকাল নয়টায় ঘটনাস্থলে আসেন। এরপর দেখতে পান, ভবনে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের নানা ধরনের কাজে সহযোগিতা করতে থাকেন। তবে বেলা ১১টার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের মুখে প্রথম শুনতে পান, ভবনে অনেক মরদেহ পড়ে আছে। তখন আনোয়ারের মন খারাপ হয়ে যায়। আর সত্যিই সত্যিই নিজে যখন ভবনের বিভিন্ন তলায় পোড়া মরদেহ দেখতে পান, তখন আর নিজের আবেগ সংবরণ করতে পারেননি।

মরদেহ থেকে দাঁত ও হাড় সংগ্রহ করব। দাঁত ও হাড়ের মাধ্যমে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করতে কমপক্ষে ২১ দিন সময় লাগবে।
সিআইডির বিশেষ সুপার (ফরেনসিক) রোমানা আক্তার

আনোয়ার রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছাসেবী, ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো মানুষ। এমন মৃত্যু যে মানুষগুলো চেনার কোনো উপায় নেই। পুড়ে যাওয়া মানুষটি কি নারী না পুরুষ, তাও কেউ বুঝতে পারবে না। একসঙ্গে এত পোড়া মানুষ আমি দেখিনি। এমন মৃত্যু মানা যায় না।’

দুপুর ১২টার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে ভবনের ফ্লোরে পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো উদ্ধারে অংশ নেওয়া অপর চার স্বেচ্ছাসেবী হলেন নাসির মোল্লা, শিহাবুল ইসলাম, আমির হোসেন ও রিয়া খাতুন।

একে একে ভবন থেকে লাশ বের করা হচ্ছে।
ছবি: আসাদুজ্জামান

বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনের সূত্রপাত। কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, ছয়তলা ভবনের নিচতলায় প্রথমে আগুন লাগে। পরে মাত্র ২০ মিনিটে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ভবনে আটকে পড়া শ্রমিকেরা বাঁচার জন্য কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন। তবে ভবনে যে এতগুলো মানুষ আটকে ছিল, এতগুলো মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে পড়ে আছে, সে তথ্য সবার সামনে আসে আগুন লাগার ২০ ঘণ্টা পর। আগুন লাগার পর নিখোঁজ শ্রমিকদের সন্ধানে ছবি হাতে নিয়ে স্বজনেরা কারখানা ও হাসপাতালে ঘুরছেন।

লাশ উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবীরা।
ছবি: আসাদুজ্জামান

কারখানা থেকে উদ্ধার করা ৪৯ জনের মরদেহ রাখা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। নিখোঁজ শ্রমিকদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।

সিআইডির বিশেষ সুপার (ফরেনসিক) রোমানা আক্তার ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মরদেহ থেকে দাঁত ও হাড় সংগ্রহ করব। দাঁত ও হাড়ের মাধ্যমে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করতে কমপক্ষে ২১ দিন সময় লাগবে।’