একে তো সিটি করপোরেশনের পানির সংযোগ নেই, তার ওপর পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। নলকূপ পানিশূন্য। এ অবস্থায় সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের পানির জন্য একমাত্র ভরসা সুরমা। নদী থেকে পাইপ টেনে মোটরের সাহায্যে পানি তুলে প্রয়োজন মেটাচ্ছেন ওয়ার্ডের অন্তত চারটি এলাকার বাসিন্দারা।
এভাবে মোটরের সাহায্যে পানি তুলতে গিয়ে অনেকে ঝুঁকির আশ্রয় নিয়েছেন। উন্মুক্ত এলাকায় মোটর বসিয়ে কিংবা বৈদ্যুতিক খুঁটির সাহায্যে পাইপ টেনে নদী থেকে পানি উত্তোলন করছেন তাঁরা। এ কারণে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন ওয়ার্ডবাসী।
জানা যায়, সিলেট শহর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয় ২০০২ সালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দক্ষিণ সুরমার ২৫, ২৬ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে পানির সংযোগ দেয়নি সিটি কর্তৃপক্ষ। নিয়মিত কর পরিশোধ করলেও এই তিন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা পানি থেকে ১৩ বছর ধরে বঞ্চিত।
এই তিন ওয়ার্ডের প্রায় সব এলাকায় কমবেশি পানির সংকট রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা ভার্থখলা, কদমতলী, ঝালোপাড়া, সাধুরবাজার, কায়স্থরাইল, স্টেশনরোড, টেকনিক্যাল রোড ও আলমপুরে।
২৫ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের সঙ্গে সুরমা নদীর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভার্থখলা, চাঁদনিঘাট, ঝালোপাড়া ও কদমতলী নদীতীরবর্তী। এই চার এলাকায় ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষের বসবাস।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিটি করপোরেশন হওয়ার আগে তাঁরা নলকূপের মাধ্যমে পানি তুলে চাহিদা মেটাতেন। কিন্তু ছয়-সাত বছর ধরে অনেক স্থানে পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে না। নলকূপে পানি ওঠে না। এ অবস্থায় লোকজন নদী থেকে পানি তুলে চাহিদা মেটাচ্ছেন।
নগরে নলকূপ বসানোর কাজ করছে সিটি করপোরেশন। করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, অনেক এলাকায় নলকূপ বসানোর মতো পানির স্তর কখনোই ছিল না। এর মধ্যে ভার্থখলা, ঝালোপাড়া, চাঁদনিঘাট ও কদমতলী অন্যতম। এমনকি এসব এলাকায় শ্যালো নলকূপেও খুব একটা পানি পাওয়া যায় না। ছয়-সাত বছরে পানির স্তর আরও নিচে নেমে গেছে।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁদনিঘাট থেকে কদমতলী সড়কের বিভিন্ন স্থানে নদী থেকে অন্তত ৪৮টি পানির লাইন টানতে দেখা যায়। এর মধ্যে ঝালোপাড়ায় সবচেয়ে বেশি। সেখানে বৈদ্যুতিক খুঁটির সাহায্যে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে ঝুঁকি নিয়ে পানির পাইপ টানা হয়েছে। একই খুঁটিতে বৈদ্যুতিক তার, টেলিফোনের তার ও পানির মোটা পাইপ ঝুলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঝালোপাড়ায় সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নদীর তীর ঘেঁষে স্টিলের রেলিং বসানো হয়েছে। নদীতে নামার জন্য করা হয়েছে পাকা সিঁড়ি। সেই সিঁড়িতে খোলা জায়গায় মোটর বসিয়ে লোকজন পাইপের সাহায্যে বাড়িতে পানি টানছেন। আর যাঁদের মোটর বসিয়ে পাইপ টানার সামর্থ্য নেই, তাঁরা সরাসরি নদীতে গিয়ে পানি আনছেন।
ঝালোপাড়ার ভুক্তভোগী বাসিন্দা আবদুল হক বলেন, চার-পাঁচ বছর আগেও এলাকায় পানির স্তর সহজেই পাওয়া যেত। এখন স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপ বসিয়েও লাভ হয় না।
এলাকার ইছাক মিয়া (৬৫) জানান, তিনি ১৬৫ ফুট গভীর নলকূপ বসিয়েছিলেন। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এখন আর নলকূপে পানি পান না। তাই নদীই একমাত্র ভরসা।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, দক্ষিণ সুরমার এই তিন ওয়ার্ডে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি লিটার পানির চাহিদা। তিন ওয়ার্ডের পানির সমস্যা দূর করতে ৪০টি গভীর নলকূপ বসিয়েছে সিটি কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে ১০টি। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফলে প্রায়ই স্থানীয় লোকজনের তোপের মুখে পড়তে হয় কর্মকর্তাদের।
যোগাযোগ করলে সিটি করপোরেশনের একজন প্রকৌশলী বলেন, এই তিন ওয়ার্ডসহ মহানগরে পানি সরবরাহের জন্য ১৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পানির সমস্যা পুরোপুরি কেটে যাবে।
কিন্তু প্রকল্পের কাজ খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৌফিক বক্স। তিনি বলেন, পানির অভাবে দক্ষিণ সুরমার তিন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা খুবই কষ্টে আছেন। যত দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ হবে, ততই মঙ্গল।
এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হানিফ বলেন, মহানগরের উত্তর অংশে পানির পাইপ বসানোর কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। দক্ষিণ অংশের কাজও মাস খানেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, ‘মহানগরে পানি সরবরাহ প্রকল্পের যে কাজ চলছে, সেটি শেষ হলে দক্ষিণ সুরমার প্রায় দুই কোটি লিটার চাহিদার বিপরীতে সিটি কর্তৃপক্ষ কমপক্ষে অর্ধেক চাহিদা পূরণ করতে পারবে। আপাতত সেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর কোনো সুখবর আমাদের কাছে নেই।’
এনামুল হাবীব আরও বলেন, ‘নদী থেকে মোটরের সাহায্যে পানি তোলার বিষয়ে আমরা অবহিত নই। অরক্ষিতভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে কেউ নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।’