তিস্তা নদী দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে কম পানি আর বর্ষাকালে বেশি পানি আসছে। এতে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ এবং অর্থনীতি সমস্যায় পড়েছে। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি হওয়ার কথা শোনা গেলেও বছরের পর বছর ধরে তা ঝুলে আছে। তিস্তার বাংলাদেশ অংশে উন্নয়ন প্রকল্প নিতে গেলেও তা ভূরাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠছে। ফলে এই নদীর পানির সমস্যা সমাধানে খুব সাবধানে এগোতে হবে। কোনো দেশের সঙ্গে শত্রুতা না করে উন্নয়ন করতে হবে।
বৃহস্পতিবার একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত সপ্তম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে বক্তারা এসব কথা বলেন। তিন দিনব্যাপী এবারের সম্মেলনের মূল বিষয় ‘তিস্তা নদী অববাহিকা: চ্যালেঞ্জ উত্তরণের উপায়’। সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নদী বিশেষজ্ঞরা অংশ নিচ্ছেন।
সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, তিস্তা কৃষি, মৎস্য এবং খাদ্যব্যবস্থার জন্য পানির একটি প্রধান উৎস। পানি ও নদীশাসন, আঞ্চলিক বিরোধ ও জলবায়ু পরিবর্তন ধারাবাহিকভাবে জনগণের অধিকারকে প্রভাবিত করেছে। তাই টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের মাধ্যমে নদীকে রক্ষা করা জরুরি।
সাংসদ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘তিস্তা রক্ষায় ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশকে একত্রে কাজ করতে হয়। এ জন্য দুই দেশকে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। কারণ, এরই মধ্যে নদী বিশেষজ্ঞরাও এর পক্ষে মত দিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে দুই দেশ এ ব্যাপারে একমত হয়েছে। এখন সেই পথে আমাদের এগোতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তিস্তার ওপরে ৩১টি ড্যাম তৈরি হয়েছে, যার বড় অংশ সিকিমে। এগুলোর অনেকগুলোতে বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। বাকিগুলো সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। তিস্তাপারের স্থানীয় জনগোষ্ঠী এসব ড্যাম নিয়ে আন্দোলন করছে। তারা বলছে, এগুলো শুধু নদীর বুকে পলি জমাচ্ছে আর জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করছে তা নয়। এর মাধ্যমে তিস্তার পানি ও পার্শ্ববর্তী ভূমিতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী অধিকার হারাচ্ছে। ফলে তিস্তা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, তা ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যাও বটে।
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনায় যে প্রকল্পটি নিতে যাচ্ছে, তাতে খনন থেকে শুরু করে বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রাখার অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। চীন এতে অর্থায়ন করার আগ্রহ দেখাচ্ছে। অন্যদিকে বছরের পর বছর আমরা তিস্তা নিয়ে ভারতের কাছ থেকে একই কথা শুনে আসছি। কিন্তু এর মধ্যে আমাদের তিস্তা অববাহিকার অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে তিস্তা নদীর সমস্যা আমাদের জন্যে একটি ভূরাজনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশকে কোনো দেশের সঙ্গে শত্রুতা না করে উন্নয়ন করার নীতিতে যেতে হবে। তবে তিস্তা ব্যবস্থাপনায় চীন থেকে অর্থ নিয়ে বাংলাদেশ প্রকল্প করতে যাচ্ছে। এতে কৃষি উৎপাদন বাড়বে, যার অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ ওই ঋণের টাকা শোধ করতে পারবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘তিস্তা প্রকল্পে চীন ১০০ কোটি ডলার দেবে শুনেছি। এটি এখন আমাকে হয়তো শোধ দিতে হবে না। কিন্তু আমার সন্তানদের দিতে হবে। এর বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত আমাদের কাউকে জানানো হয়নি। এই নদীর মধ্যে কী পরিমাণে পলি জমা হয়, তা বিবেচনা না করলে এখানে কোনো ধরনের প্রকল্প নেওয়া উচিত নয়। এখানে যে ধরনের পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে বলে শুনতে পাচ্ছি, তাতে পলি জমে এখানে আরও বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে।’
আইনুন নিশাত বলেন, এই নদী বেশ অদ্ভুত আচরণ করে। এর উজানে এবং ভাটিতে পানির প্রবাহ ভিন্ন রকম। এর ভূগর্ভের পানি একেক জায়গায় একেক রকম। এখানে শুষ্ক মৌসুমের চেয়ে বর্ষায় প্রায় ৪০ গুণ পানি বেড়ে যায়। তাই এখানে দুই দেশকে আলোচনার মাধ্যমে পানি ধরে রাখার রিজার্ভার তৈরি করতে হবে। এ জন্য দুই দেশকে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
নরওয়ের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অশোক সোয়াইন বলেন, তিস্তা নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অনেক বেশি তীব্র। তাই এটি নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।
সম্মেলনে তিস্তা নদীর ওপরে তৈরি একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এ ছাড়া সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী মনজুর হাসান, জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোহান ডি সুজা, ব্রুনাই দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইফতেখার ইকবাল।