
দল গুছিয়ে নিয়ে ‘অবৈধ সরকারের’ বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন,
দল গোছানোর জন্য বেশি সময় লাগবে না।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে গুলশানের একটি হোটেলে বিএনপি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘জবরদস্তি ও ত্রাসের এই বেআইনি শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ বেশি দিন নীরব থাকবে না। বিএনপি নিশ্চেষ্ট থাকবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এক মাসে সারা দেশে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের একটা চিত্র তুলে ধরেন। তিনি দাবি করেন, এই সময়ের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের প্রায় ৩০২ নেতা-কর্মী নিহত ও গুম হয়েছেন। এর মধ্যে ২৪২ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা ও ৬০ জনকে গুম করা হয়েছে।
খালেদা জিয়া এসব খুন ও গুমের জন্য সরকারকে দায়ী করেন এবং এটাকে ‘দুর্বলের ভয়ংকর প্রতিশোধ’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এদের পরাজয়ের গ্লানি ভয়াবহ, অক্ষমতার জিঘাংসা মারাত্মক।’ তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিনা বিচারে হত্যা ও গুম একটি সভ্য সমাজে চলতে পারে না। রাষ্ট্রীয় ও ক্ষমতাসীনদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সব মানবাধিকার সংগঠনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন কবে শুরু হবে—সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘আমাদের বহু নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। অনেকেই জেলে আছেন। দল গুছিয়েই আন্দোলন শুরু করা হবে। এ জন্য বেশি সময় লাগবে না।’ তিনি বলেন, ‘রাজনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কে আমার যতটুকু জ্ঞান আছে, তা থেকে বুঝি, আজকের সভ্য পৃথিবীতে দু-একটি সার্টিফিকেট জোগাড় করে এই অন্যায় ও অবৈধ শাসনকে প্রলম্বিত করা সম্ভব নয়।’
‘সময় থাকতে’ সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার তাগিদ দেন খালেদা জিয়া। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা অনির্দিষ্টকাল ধরে শুধু সংলাপ ও সমঝোতার আহ্বান জানিয়েই যাব, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।’
প্রায় সোয়া ঘণ্টা ধরে চলা সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের আরও কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেন। বিএনপি কবে নাগাদ নির্বাচন চায় এবং সরকারকে কোনো সময় বেঁধে দেবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘অতি দ্রুত নির্বাচন চাই।’ তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না যাওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। যারা মনে করে, বিএনপি ভুল করেছে, তাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ওই নির্বাচন করে সরকারই সবচেয়ে বড় ভুল করেছে।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ না ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা নয়—সরকারের এই অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি এখন কী করবে? জানতে চাইলে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিএনপি কার সঙ্গে থাকবে, না থাকবে, সেটা দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। অন্যের নির্দেশে বিএনপি চলবে না। তা ছাড়া একসময় আওয়ামী লীগও জামায়াতের সঙ্গে ছিল।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ডেমোক্রেটিক ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) সাম্প্রতিক জরিপকে ইঙ্গিত করে বলেন, এ জরিপের কোনো মূল্য নেই।
সরকারকে অবৈধ বলে মন্তব্য করলেও তার কাছে কয়েকটি দাবি তোলেন বিএনপির প্রধান। এসব দাবির মধ্যে আছে হত্যা, গুম, উৎপীড়ন ও ‘বিরোধী দল নির্মূলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ অবিলম্বে বন্ধ এবং সব হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত, বিনা বিচারে হত্যা করা হলে তার বিচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অপহরণ-গুম বন্ধ, গুমের ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা, নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার-হয়রানি বন্ধ, তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তি, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও মিছিলের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া, বন্ধ সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া এবং আটক সাংবাদিকদের মুক্তি।
‘আসনের ভাগ দিতে চেয়েছিল’: বিএনপির চেয়ারপারসন মন্তব্য করেন, বিনা ভোটে ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখল করেছে। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসন ভোটের আগেই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। বিএনপিকেও তারা এর ভাগ দিতে চেয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ চরম সুবিধাবাদী। যখন যেটা সুবিধাজনক মনে করে, তখন সেটা বলে ও করে। আবার সুবিধা না হলে চরম বিপরীত অবস্থান নিতেও তারা সামান্যতম লজ্জাবোধ করে না।...আওয়ামী লীগের হাতে রচিত হয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র হত্যার কলঙ্কিত দ্বিতীয় অধ্যায়।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার: খালেদা জিয়া বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঘাতক বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। বাইরের নির্দেশনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিরোধী দল নির্মূলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশজুড়ে এক চরম অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পাশাপাশি ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগও উঠছে। তিনি বলেন, ‘আমরা খবর পেয়েছি, এসব বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য বেআইনি জুলুম-নির্যাতন চালানোর বিরুদ্ধে। কিন্তু অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা তাঁদের বেআইনি কর্মকাণ্ডে বাধ্য করছেন।’
এ ছাড়া ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ওই শোকাবহ দিনে ঢাকায় এশিয়া কাপ ক্রিকেটের উদ্বোধন উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ নাচ-গান অনুষ্ঠানের আয়োজনের কথা শোনা যাচ্ছে। বেদনাবিধুর ওই দিনটিতে কোনো আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান না করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, মাহবুবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর মশিউল আলম, খেলাফত মজলিসের মো. ইসহাক, বিজেপির আন্দালিব রহমানসহ ১৯-দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।