ছোট ভাই রাজু স্কুলে যেতে পারলেও ঘরের কাজের জন্য স্কুলে যাওয়ার অধিকার ছিল না মীনার। স্কুলের জানালায় উঁকি দিয়ে মীনা শুনে নিত শিক্ষকের পাঠ। ‘দুই একে দুই, দুই দুগুণে চার, তিন দুগুণে ছয়’ পোষা টিয়া পাখি মিঠুর মাধ্যমে নামতা শিখে একদিন মুরগি চোর ধরতে পেরেছিল মীনা। এ ঘটনার পরই স্কুলবঞ্চিত মীনাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন মা–বাবা।

মেয়েদের স্কুলে পাঠানোকে উৎসাহিত করতে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম প্রচারিত হয় মীনা কার্টুনের ওই পর্বটি। তবে ২৮ বছর পরের চিত্র জানান দিচ্ছে এই ‘মীনা’দের জয়জয়কার। প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণে ‘রাজু’দের চেয়ে ‘মীনা’রা এখন এগিয়ে।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মেয়েদের শিক্ষাসহ সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে নব্বই দশকে ‘মীনা’ নামের ধারাবাহিক কার্টুন চলচ্চিত্র তৈরি করে। মীনা হলো এই ধারাবাহিকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। মীনা ৯ বছরের একটি মেয়ে, যে শিক্ষার অধিকার চায়, সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১০ থেকে সর্বশেষ ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে, এই এক দশকে প্রাক্‌–প্রাথমিক ও প্রাথমিকে ভর্তি, ঝরে পড়া, টিকে থাকা, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার একটি চক্র পূরণ করা এবং একই ক্লাসে আবার পড়া (পরীক্ষায় পাস না করা বা অন্য কোনো কারণে) এই পাঁচ সূচকের প্রতিটিতে মেয়েরা এগিয়ে। করোনাকালে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাকে সামনে নিয়ে আজ ২৪ সেপ্টেম্বর আবার এসেছে ‘মীনা দিবস’।

প্রতিবছর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর মীনা দিবস পালন করে। তবে এবার কোভিড পরিস্থিতির কারণে কোনো আয়োজন থাকছে না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, অবৈতনিক শিক্ষা কার্যক্রম, প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উপবৃত্তি, বিনা মূল্যে বই, পাইলট আকারে স্কুলে খাবার কর্মসূচি, ৭০ শতাংশ নারী শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষায় সাফল্য, বিশেষ করে মেয়েশিশুর সংখ্যা বাড়িয়েছে। কোভিডে সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতা যেন নষ্ট না হয়, সে জন্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

অনেক স্বপ্ন সোহানাদের

সোহানা হতে চায় সিআইডির একজন (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ) কর্মকর্তা। মিতু চাকরি করতে চায়। ফারজানার আপাতত লক্ষ্য উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত যাওয়া। রিয়া, শান্তা, পূজা রানি একেকজনের স্বপ্ন একেকটা। এই মেয়েদের দেখা পাওয়া যায় মঙ্গলবার রাজধানীর শাহজাদপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে। ওই দিন শুধু প্রথম ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস ছিল।

স্কুলটিতে প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৪৫। এর মধ্যে মেয়ে ২৭৭, ছেলে ১৬৮ জন। প্রধান শিক্ষক ও ১৩ জন শিক্ষকের সবাই নারী। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফাহিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্কুলে মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনায় দক্ষতা ও আন্তরিকতা দুটোই বেশি। সাধারণত আশপাশের এলাকার পরিবারগুলোর সন্তানেরা এখানে পড়ে।

পাঁচ সূচকেই এগিয়ে

এক দশকে প্রাথমিকে মেয়েশিশু ভর্তি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। প্রাক্‌–প্রাথমিক ও প্রাথমিকে ২০১০ সালে মোট ভর্তি হয়েছিল ১ কোটি ৮২ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯১ শিশু শিক্ষার্থী। এর মধ্যে মেয়ে ছিল ৯১ লাখ ৫৮ হাজার ২১০ জন, যা ছেলেদের তুলনায় অর্ধলাখের বেশি। ২০২০ সালে ২ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৯১টি শিশু ভর্তির মধ্যে মেয়ে ছিল ১ কোটি ৯ লাখ ৯১ হাজার ৪৫১ জন, যা ছেলেদের তুলনায় সোয়া ৪ লাখের চেয়ে বেশি। এক দশকে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার কমেছে আড়াই গুণের বেশি, ছেলেদের দুই গুণের বেশি। স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের টিকে থাকার হার বেড়েছে ১৭ শতাংশের বেশি, ছেলেদেরও তাই। তবে তুলনামূলক বিচারে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের টিকে থাকার হার আড়াই শতাংশ বেশি। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত চক্র পূরণ করার হার বেড়েছে মেয়েদের ২৪ এবং ছেলেদের ২১ শতাংশ। একই শ্রেণিতে একাধিকবার পড়ার হার কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো অবস্থানে।

ঝরে পড়ার হার বুঝতে গবেষণা শুরু

করোনাকাল প্রাথমিক শিক্ষায় নেতিবাচক কি প্রভাব ফেলল তা বুঝতে গবেষণা শুরু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাক্‌–প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। এই বিভাগের অধ্যাপক তাপস কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ঝরে পড়ার হার যতটা বেশি হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, ততটা হবে না বলে মনে হচ্ছে। এ হার ৫–১০ শতাংশ হতে পারে। তিনি বলেন, প্রাথমিকে মেয়েদের সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে একটা প্রজন্মের পর দেশে আর নিরক্ষর জনসংখ্যা থাকবে না। যে পরিবারে মা পড়াশোনা জানে, সেই পরিবারে শিক্ষা গুরুত্ব পায় বেশি।