দুই সংগঠনের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হিসাবে ফারাক ২ হাজার

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের আলোচনা সভা‍য় বক্তব্য দেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।
ছবি: দীপু মালাকার

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত বছর সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। একই ধরনের আরেক সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই–এর (নিসচা) হিসেবে, গত বছর ৩ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ২৮৯ জন নিহত হয়েছেন। দুটি সংগঠনই আজ শনিবার পৃথক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরে।

দুই সংগঠনের হিসাবে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যায় দুই হাজারের ফারাক। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান সারা দেশে দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করে না। বেসরকারি একাধিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে দুর্ঘটনার তথ্য রাখে। সংগঠনগুলোর তথ্যের উৎস মূলত পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদমাধ্যম।

সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো পত্রিকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। কেউ হয়তো চারটি পত্রিকার সংখ্যা নেয়, কেউ আটটি। এ জন্যই তাদের সংখ্যায় এত তারতম্য হয়। একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উন্নত পদ্ধতি মেনে দুর্ঘটনার সংখ্যা নিরূপণ করা উচিত।
এ আর আইয়ের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আধুনিক, উন্নত প্রযুক্তি ও  পদ্ধতি মেনে দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা নিরূপণ করা প্রয়োজন।

আজ সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘২০২১ সালের সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। তাতে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংগঠনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। গত বছর ৭৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৫৯ জন নিহত এবং ১৯২ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় ৪৭ জন নিখোঁজ রয়েছেন। আর ১২৩টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত এবং ৩৯ জন আহত হয়েছেন।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ আর প্রাণহানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮০৩ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে তথ্য তুলে ধরে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন
ছবি: প্রথম আলো

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত তিন বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় সমান। মূলত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ার কারণে ২০২১ সালে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মোট সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

সংবাদ সম্মেলনে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার সমস্যাটি রাজনৈতিক। কারিগরিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না। এত বিশৃঙ্খল-উচ্ছৃঙ্খল সড়কব্যবস্থা চাইলেই আধুনিক, নিরাপদ করা সম্ভব না। যাঁরা সড়কে বিশৃঙ্খলার সুবিধাভোগী, তাঁরাই নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন কমিটিতে বসে আছেন।

জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ‘২০২১ সালের সড়ক দুর্ঘটনা পরিসংখ্যান উপস্থাপন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নিসচা। সংগঠনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন। নিসচার হিসাবে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও আহত ব্যক্তির সংখ্যা এর আগের দুই বছরের তুলনায় বেড়েছে।

২০১২ সাল থেকে নিয়মিত দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করছে নিসচা। সংগঠনটি জানিয়েছে, এই পরিসংখ্যান ও প্রতিবেদনের কাজটি করা হয়েছে পুরোপুরি সেকেন্ডারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। এতে ১১টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার তথ্য, অনলাইন পোর্টাল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তথ্য এবং নিসচার শাখা সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন যুক্ত হয়েছে।

নিসচার প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর সড়কে ৩ হাজার ৭৯৩টি দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ২৮৯ জন নিহত ও ৫ হাজার ৪২৪ জন আহত হয়েছেন। রেলপথে ২৭০টি দুর্ঘটনায় ২৫৪ জন নিহত ও ৪২ জন আহত হয়েছেন। আর নৌপথে ৯০টি দুর্ঘটনায় ১৯৮ জন নিহত এবং ৩৩৯ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় ১৮৬ জন নিখোঁজ রয়েছে।

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ২১ শতাংশ। করোনার বিধিনিষিধের কারণে অফিস-আদালত, দোকানপাট ও গণপরিবহন বন্ধ ছিল। তাতে ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কম হওয়ার কথা। অথচ, আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হওয়াটা উদ্বেগজনক।

সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে ভিন্নতার বিষয়ে জানতে চাইলে এ আর আইয়ের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো পত্রিকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। কেউ হয়তো চারটি পত্রিকার সংখ্যা নেয়, কেউ আটটি। এ জন্যই তাদের সংখ্যায় এত তারতম্য হয়। একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উন্নত পদ্ধতি মেনে দুর্ঘটনার সংখ্যা নিরূপণ করা উচিত।