গত ২৩ মার্চ গোদাগাড়ীর নিমঘটু গ্রামের সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারানডি (৩৭) ও তাঁর চাচাতো ভাই রবি মারানডি (২৭) বিষ পান করেন। এতে অভিনাথ সেদিনই মারা যান। রবি মারা যান ২৫ মার্চ। পরিবারের দাবি, নলকূপের অপারেটর ও ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি সাখাওয়াত এই দুই কৃষকের বোরো ধানের জমিতে পানি না দিয়ে হয়রানি করছিলেন। পানি না পেলে তাঁরা বিষ পানের হুমকি দিয়েছিলেন। অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনও তাঁদের বিষ পান করতেই বলেছিলেন। এরপর তাঁরা দুজনে গভীর নলকূপের সামনেই বিষ পান করেন। পরে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) পরিচালিত ঈশ্বরীপুর-২ গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে মামলা করেন অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম।
এ ঘটনায় দুটি তদন্ত হয়। একটি তদন্ত করেছে কৃষি মন্ত্রণালয় ও অপরটি করেছে বিএমডিএ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবু জুবাইর হোসেন বাবলু। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব সায়েদুল ইসলামের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন তাঁরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত দুই কৃষকের একজন অভিনাথ মারানডি বিষ পানে আত্মহত্যা করেছেন। অপরজন রবি মারানডির বিষ পানের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে তিনি মৃত্যুর আগে চুয়ানি বা দেশি মদ খেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান আবু জুবাইর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরেজমিন ওই গ্রামে ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পেরেছি, তা তদন্ত প্রতিবেদনে লিখে জমা দিয়েছি।’
সেচের পানি না পেয়ে কৃষকেরা আত্মহত্যা করতে পারেন, এটা এ ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে। এখন সরকারের উচিত পানি ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের বিষয়টিকে আমলে নিয়ে দ্রুত এর টেকসই সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া।শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
কৃষকদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করতেন সাখাওয়াত
তদন্তকারীদের মতে, পানি নেওয়ার সময় অভিযুক্ত সাখাওয়াত হোসেন কৃষকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন অনিয়মে যুক্ত ছিলেন তিনি। এর আগে বিএমডিএর নিজস্ব তদন্ত কমিটি এ ঘটনায় অভিযুক্ত সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে সেচের জন্য পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বলে জানিয়েছে। সাখাওয়াতকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ। ২ এপ্রিল পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। এখন তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আছেন।
এ বিষয়ে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, সাখাওয়াত সেচের পানি দেওয়ার জন্য কৃষকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিতেন। টাকা না দিলে পানি দিতেন না তিনি। এসব অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সেচের পানির জন্য কৃষকদের বিশেষ কার্ড দিয়ে থাকে বিএমডিএ। নিহত দুই কৃষকের মধ্যে একজনের কার্ড ছিল না। আরেকজনের থাকলেও তিনি কখনোই ওই কার্ড ব্যবহার করেননি। তবে তাঁরা নিয়মিত বরেন্দ্রের সেচ প্রকল্প থেকে পানি নিয়ে আসছিলেন বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরেন্দ্র এলাকায় সেচের পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অনিয়ম কমে আসবে বলে আমরা ভেবেছিলাম। কিন্তু ওই দুই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছে, ব্যবস্থাপনায় এখনো গলদ রয়ে গেছে। গভীর নলকূপের নিয়ন্ত্রণ এখনো স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রের হাতে। পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও বাড়তি টাকা পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করে। এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে হবে।’
সেচের পানি ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম দূর করা জরুরি বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিকও। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সেচের পানি না পেয়ে কৃষকেরা আত্মহত্যা করতে পারেন, এটা এ ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে। এখন সরকারের উচিত পানি ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের বিষয়টিকে আমলে নিয়ে দ্রুত এর টেকসই সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া।’
তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারীরা বলেছেন, তাঁরা অভিনাথ মারানডি ও রবি মারানডির সুরতহাল প্রতিবেদন হাতে পাননি। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানা-পুলিশের গঠন করা তদন্ত কমিটিও এখনো সুরতহাল প্রতিবেদন পায়নি। সাধারণত কোনো ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে সুরতহাল প্রতিবেদন দেওয়া হয়। কিন্তু দুই কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল থেকে এখনো তাঁদের সুরতহাল প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি।
গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুরতহাল প্রতিবেদন তদন্তের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি হাতে পেলে আমরা দ্রুত আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিতে পারব।’
মৃত্যুর কারণ নিয়ে ভিন্নমত
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেচের পানি না পাওয়ায় তাঁর স্বামী বিষ পানে আত্মহত্যা করেছেন বলে তদন্তকারীদের জানিয়েছেন অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা। তিনি দাবি করেন, মৃত্যুর আগে বিষ পানের এই কারণ তাঁর স্বামী নিজেই তাঁকে বলে গেছেন। তবে অভিনাথের ভাবি পার্বতী তদন্তকারীদের জানান, কী কারণে বিষ পান করেছিলেন, তা কাউকে জানিয়ে যেতে পারেননি অভিনাথ।
ভ্যানচালক বাপ্পী অভিনাথকে বিষ পানের পর গভীর নলকূপের কাছ থেকে নিয়ে আসেন। তিনি তদন্তকারীদের বলেন, ভ্যানে তোলার সময় অভিনাথের মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। তিনি টেনশনে বিষ পান করে থাকতে পারেন।
অন্যদিকে নিহত রবির ভাই সুশীল মারানডি ও মাইকেল মারানডি তদন্তকারীদের বলেছেন, সেচের পানি না পেয়ে বিষ পানের কথা মৃত্যুর আগে রবি তাঁর মায়ের কাছে বলে গেছেন। মায়ের কাছ থেকে তাঁরা এ কথা শুনেছেন। এ ছাড়া আর কেউ বিষ পানে রবির মৃত্যু হয়েছে বলে সাক্ষ্য দেননি। ওই ঘটনার আরেক সাক্ষী গোপাল মারানডি বলেছেন, মৃত্যুর আগে রবি চুয়ানি খেয়েছিলেন। ঘটনার দিন অভিনাথকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া গ্রামীণ চিকিৎসক মুর্শেদ বলেন, অভিনাথের পেট পরিষ্কার করার সময় বিষের গন্ধ পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৃত্যুর আগে স্ত্রী ও মাকে কেউ মিথ্যা বলেন না। তাই তাঁদের সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের কাছে নিহত ব্যক্তিরা কী বলে গেছেন, সেটা পুলিশের তদন্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে কী ফল পাওয়া গেছে, তা খুব একটা কাজে আসবে না।’