সামনে চ্যালেঞ্জ: ২০২২
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা জনবান্ধব হবে আর কত দিনে
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক অর্জন থাকলেও ঘাটতির নানা দিক রয়েছে। আত্মতুষ্টির ঢেকুরে বুঁদ হয়ে না থেকে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে তাকানো জরুরি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কম নয়। ক্ষয়ক্ষতি আর প্রাণহানি কমিয়ে আনার নানা ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে নানাভাবে, নানা পর্যায়ে। প্রযুক্তির উন্নতি আমাদের সহযোগিতা করছে। দুনিয়াজুড়ে চলছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক করার নানা কৌশলের চর্চা আর উদ্ভাবন। বাংলাদেশ সেই সব বৈশ্বিক প্রস্তুতিতে শামিল হচ্ছে, বক্তব্য দিচ্ছে, পরিবর্তন করছে নিজেকে। পরিবর্তন এসেছে দুর্যোগকে বিশ্লেষণ করার দৃষ্টিভঙ্গিতেও। দুর্যোগ মোকাবিলার শক্তি বাড়ানোর কাজ ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে, বেগবান হচ্ছে। বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসের কাজগুলো দৃঢ় করে আর্থিক ক্ষতি কমিয়ে আনা সরকারের এখন অন্যতম লক্ষ্য। দারিদ্র্য হটানোসহ সামাজিক নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো দেশের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে।
অবশ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের এত অর্জন থাকলেও ঘাটতির নানা দিক রয়েছে। আত্মতুষ্টির ঢেকুরে বুঁদ হয়ে না থেকে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে তাকানো, জনগণের চাহিদাকে আমলে নিয়ে তাদের নেতৃত্বে কীভাবে এগোনো যায়, তার সুলুক সন্ধান জরুরি। এক বছরে হয়তো সবটা সম্ভব হবে না। তবে কাজটা শুরু হতে পারে। উপকূলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে আমাদের প্রধান সহায় হয়ে দাঁড়ায় আশ্রয়কেন্দ্র, বাঁধ, সতর্কবার্তা, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির স্বেচ্ছাসেবক আর গাছপালা বা বনভূমি। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এগুলো আরও জনবান্ধব করা যায় কীভাবে, সেই প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রশ্নের একটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ উত্তর খোঁজা জরুরি।
তালগাছ আর বজ্রপাত
হাওর জেলা সুনামগঞ্জের সরস্বতীপুর গ্রামে ২০১১ সালে বজ্রপাতে একসঙ্গে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। গত বছর আগস্ট মাসের শুরুতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বজ্রপাতে বরযাত্রী দলের ১৭ জনের মৃত্যু হয়। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে এই প্রাকৃতিক ঘটনার ওপর গবেষণা চালিয়েছে। তারা বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুন মাসে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ১ হাজার ৮৭৮ জন, যাদের ৭২ শতাংশই কৃষক। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে এর প্রতিকারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। তখন এক কোটি তালগাছ লাগানো এবং বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বজ্রনিরোধক যন্ত্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু চার বছর পর এসে দেখা গেল, কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ৩৫ লাখ তালগাছ লাগানো হয়েছে বলে দাবি করেছে। তাদের দাবি যদি সঠিকও হয়ে থাকে, সেগুলো বজ্রপাত নিরোধ করার অবস্থায় আসেনি। একটি তালগাছ বড় হতে ১০ বছর সময় লেগে যায়। দ্বিতীয়ত, তালগাছ যেখানে লাগানোর কথা, সেটাও হয়নি। তালগাছ লাগানো হয়েছে প্রধানত রাস্তার পাশে। রাস্তায় বজ্রপাতে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা খুবই কম। মানুষ মারা যায় মাঠে। বিশেষ করে চাষাবাদের সময় কৃষকেরাই বেশি বজ্রপাতের শিকার হন। দেখা যাচ্ছে তালগাছ লাগানোর স্থান নির্বাচনেও ভুল হয়েছে। এসব অভিযোগের সত্য-মিথ্যা যাচাই করে প্রয়োজনে আমাদের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে।
তালগাছের বিকল্প যদি বজ্রপাত নিরোধক টাওয়ার হয়, তবে সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আরেকটা বজ্রপাত মৌসুম আসার আগেই সেটা করতে হবে। ভিয়েতনাম, নেপাল পারলে আমরা কেন পারব না? বজ্রনিরোধক যন্ত্র না বসানোর জন্য আর্থিক সংকটের দোহাই দেওয়ার আগে মানুষের জানের মূল্য বিবেচনা করতে হবে। যথাস্থানে তালগাছ, খেজুরগাছ ইত্যাদি লাগানোতে মানুষকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি তালগাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। তালগাছের নৌকা বা ডোঙার হাট আর তালগাছ রোপণ পাশাপাশি চলতে পারে না।
উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী ও জাহাজভাঙা
উপকূল বরাবর বনায়ন এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করার মাধ্যমে উপকূলবর্তী এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করা সম্ভব। সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পটি ১৯৯৫ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আনুকূল্য লাভ করে। ২০০২ সালে শেষ হওয়া এই প্রকল্পের অনেকটাই এখন মলিন। গত ২৫ বছরে দেশের উপকূলভাগে ৫০ ভাগের বেশি সুশোভিত কেওড়া-বাইন-ঝাউবন, প্যারাবন ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। ভাঙারি জাহাজের কারখানা করতে গিয়ে অনেক বনভূমি উজাড় হয়েছে। ফলে সমুদ্রের ভাঙন বৃদ্ধি এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের মানচিত্র বদলে যাচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে ফসলি জমি ধ্বংস হচ্ছে। ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল অঞ্চলকে। বছর কয়েক আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের করা এক প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছিল এসব তথ্য। গ্রিনপিসসহ আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন বাংলাদেশের জাহাজভাঙাশিল্পের বর্জ্য নিষ্কাশন নিয়ে বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। কারণ, এই শিল্পের বর্জ্য হিসেবে ভারী ধাতু, তেলসহ ক্ষতিকারক সব রাসায়নিক সরাসরি নিষ্কাশিত হয় বলে সাগরের জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
কী গাছ লাগানো হচ্ছে
উপকূলীয় এলাকায় সামাজিক বনায়ন বা বনভূমি সৃজন ও তা রক্ষণাবেক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ গাছ লাগাচ্ছে এবং সেটা রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এটা খুবই ভালো খবর। কিন্তু কী গাছ লাগানো হচ্ছে, সেটাও একটা বিবেচনার বিষয়। ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর দেখা গেছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে যত মানুষ পানিতে ভেসে গেছে বা পানিতে ডুবে মারা গেছে, তার প্রায় দ্বিগুণ মানুষ মারা গেছে গাছচাপা পড়ে। উপড়ে যাওয়া গাছগুলো স্থানীয় জাতের ছিল না। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় গাছ লাগানোর সময় বাণিজ্যিক দিকের কথা না ভেবে সুরক্ষার কথা ভাবা উচিত।
আশ্রয়কেন্দ্রে কেন অনাগ্রহ
উপকূলীয় এলাকায় সব বয়সের আর বিশেষ চাহিদার কথা মনে রেখে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের নকশায় অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। গবাদি প্রাণীসহ আশ্রয় নেওয়া যায়, এমন ৩২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে প্রায় ২ লাখ ৫৬ হাজার বিপদাপন্ন মানুষ এবং প্রায় ৪৪ হাজার গবাদি প্রাণীর আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ আছে। এত কিছুর পরও মানুষ কেন নিজ ইচ্ছায় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে গড়িমসি করে? কেন নেই স্বতঃস্ফূর্ততা!
কেন যাবে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে, যেখানে তার জন্য বরাদ্দ মাত্র দুই বর্গফুট জায়গা। প্রযুক্তির উন্নয়নে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধির সাচ্চা খবর আগে জানা যেত ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা আগে। এখন সেটা জানা যায় আরও আগে। কেউ কোনো ঝুঁকি না নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার ‘আদেশ’ও জারি করছেন আগে আগে। মাত্র দুই বর্গফুট জায়গায় ঘূর্ণিঝড়ের জন্য এত সময় অপেক্ষা করা কি সম্ভব? আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি আমাদের আর কি কোনো বিকল্প নেই? বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক, প্রকৌশলী, স্থপতি হিসাব কষে দেখিয়েছেন, একটা আশ্রয়কেন্দ্রের খরচে প্রায় ৩২-৩৩টা জলোচ্ছ্বাস সহনীয় বাড়ি তৈরি করা সম্ভব। একটা আশ্রয়কেন্দ্রের প্রায় দ্বিগুণ মানুষ এই কয়টা বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে আশ্রয় নিতে পারেন। পাড়ার মধ্যে এ রকম বাড়ি থাকলে ৫০ ঘণ্টা আগে লটবহর নিয়ে ছোটাছুটির দরকার হয় না। হিসাবটা শুধু কাগজে-কলমে নয়, এমন বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় করা হয়েছে। ভিন্ন নকশায় এখন বেসরকারি উদ্যোগে এমন বাড়ি তৈরি হচ্ছে আরও অনেক জায়গায়।
বাঁধ
ঘূর্ণিঝড়ে খেপে যাওয়া সাগরকে ঠেকাতে সমতলে বাঁধ বাঁধতে হয়। আমাদের বাঁধগুলো এখন ভাদ্রের স্বাভাবিক জোয়ারে টিকতে পারে না। ওডিশায় জলোচ্ছ্বাস হলে শরণখোলার বাঁধ থাকে না। বাঁধ নির্মাণ আর তার রক্ষণাবেক্ষণে জনগণকে প্রথম থেকে সম্পৃক্ত করার দুটি সফল উদাহরণ বাংলাদেশের আছে। একটি ভোলার চর ফ্যাশনে, অন্যটি লক্ষ্মীপুরে। নির্মাণের ৩০ বছর পরও এগুলো শক্তপোক্ত আছে।
সতর্কবার্তা
এখনো আমাদের ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা আসে বন্দর আর জাহাজের জন্য। দূরবর্তী সতর্কসংকেত, দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত, স্থানীয় সতর্কসংকেত, স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত, বিপৎসংকেত, মহা বিপৎসংকেত ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত ইত্যাদি নানা সংকেতের এক জটিল ঘেরাটোপ সাধারণ মানুষ কি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে? ৫ নম্বর বিপৎসংকেত কীভাবে ৬-৭ টপকে একবারে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত হয়ে যায়, তার কোনো অঙ্ক ধলঘটা বা ছনুয়ার মানুষদের বোধগম্য নয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের আগে এসব সংকেতই প্রচারিত হয় তারে, বেতারে, মাইকে, মুঠোফোনে। কোনো রকম খরচ ছাড়াই ১০৯০ নম্বরে ফোন করলে ঝড়বৃষ্টির আগাম খবর আসে বটে কিন্তু সেই আগের বেতার ভাষণের মতো ‘দু-একটি জায়গায় কোথাও কোথাও কখনো কখনো বৃষ্টিপাত হতে পারে’ মার্কা কথা শোনা যায়। গত ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের আগমনী ঘণ্টায় কাঁটাতারের ওপারের জেলাগুলোতে যখন পঞ্চায়েত ধরে ধরে বৃষ্টির খবর আর কৃষকের করণীয় নিয়ে মাইক বাজিয়ে বার্তা প্রচার করা হচ্ছিল, তখন আমাদের ছিল সেই জাহাজের খবর সাতক্ষীরা থেকে সেন্ট মার্টিন ৩ নম্বর সতর্কসংকেতের ভাঙা রেকর্ড।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) এখন আগের থেকে অনেক বিস্তৃত। কিন্তু তার মান ও ধারাবাহিকতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। এই কর্মসূচি একসময় গ্রামীণ নেতৃত্ব বিকাশে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। গ্রামীণ মহড়াগুলো ছিল অনেক পরিকল্পিত ও আধুনিক। সম্প্রতি একটা মহড়া দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে ৩০ বছর ধরে একই বয়ান মানুষকে আর টানতে পারছে না। এই প্রতিষ্ঠানটিকে আমলাতন্ত্রের গোলকধাঁধা থেকে একটু মুক্ত রাখলে ক্ষতি কী?
বন্যা, নদীভাঙন
নদী অববাহিকার দেশ বদ্বীপ বাংলাদেশের বন্যা আর নদীভাঙন নিত্যসঙ্গী। বানের সঙ্গে বসবাসের সক্ষমতা ছিল বলেই বাংলাদেশ বিকশিত হয়েছে। বন্যা প্রতিরোধ নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত বন্যা নিয়ে আমাদের বেশি করে ভাবতে হবে। বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায় দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসের নামে দোতলা ইমারতসহ বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ঠিক হবে, নাকি মানুষের বাড়ির ভিটা আর আঙিনা উঁচু করা বেশি বিবেচনার কাজ হবে?
তবে আজকাল অববাহিকা আর জনপদভিত্তিক স্থানীয় পরিকল্পনার চেয়ে বিশাল বিশাল সব পরিকল্পনার কথা বেশি শোনা যাচ্ছে। তিস্তা অববাহিকার বন্যাকে সামাল দেওয়ার জন্য ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ এমনই একটি ‘মেগা প্রজেক্ট’।
প্রকল্পের মূল ধারণা হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ভাটি থেকে তিস্তা-যমুনার মিলনস্থল পর্যন্ত নদীর বর্তমান প্রস্থ কমিয়ে ৭০০ থেকে ১০০০ মিটারে সীমাবদ্ধ করা হবে। নদীটির গভীরতাও বাড়িয়ে ১০ মিটার করা হবে। প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী নদীশাসনের মাধ্যমে তিস্তা নদীকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হবে। নদী নিয়ে যাঁরা একটু পড়াশোনা করেছেন আর তিস্তার মতো নদীগুলোকে চেনেন, তাঁরা একবাক্যে এটাকে প্রকৃতিবিরোধী প্রকল্প বলে অবিহিত করেছেন। বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান (অধ্যাপক, লক হেভেন বিশ্ববিদ্যালয়, পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র) খুব পরিষ্কার করেই বলেছেন, নদীটি খনন করার ফলে তলদেশে যে পানি দেখা যাবে, তা আসলে নদীর দুই পাড়ের অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত ভূগর্ভস্থ পানি ছাড়া অন্য কিছু নয়। নদীতে দৃশ্যমান পানি সেচের জন্য ব্যবহার করলে অববাহিকা অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে, তাতে অগভীর নলকূপের মাধ্যমে আহরিত পানীয় জল এবং সেচের পানির প্রাপ্যতা কমে যাবে। নদীটির দুই পাড়জুড়ে বাঁধ দেওয়ার কারণে প্রস্থচ্ছেদ অনেক কমে যাবে, ফলে বর্ষাকালে পানিপ্রবাহের পাশাপাশি স্রোতের মাত্রাও অনেক বেড়ে যাবে এবং দুই পাড়ের ভাঙনপ্রবণতা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
নদীসংক্রান্ত সব মেগা প্রকল্প নিয়ে বিশেষজ্ঞদের খোলামেলা আলোচনার বছর হোক ২০২২।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নদীভাঙনে পূর্বাভাস দেওয়ার দক্ষতা প্রমাণ করেছে। সরকারের ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) সক্ষমতাকে ব্যবহার করে ভাঙনপ্রবণ এলাকার মানুষকে নদীর গতিবিধির খবর পৌঁছে দেওয়ার একটা টেকসই পথ খোঁজা জরুরি। নজর রাখতে হবে উন্নয়ন উদ্গত দুর্যোগের দিকে, বিশেষ করে নগর দুর্যোগের দিকে। দেশব্যাপী ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার কাজ শুরু হোক এই বছরে। নইলে নগর-গ্রাম কোনোটারই শেষ রক্ষা হবে না।
● লেখক ও গবেষক [email protected]