দেয়াল ঘড়ির কাঁটায় যখন বেলা আড়াইটা
‘বর্ষাকালে এখানে, শীত–গ্রীষ্মে ওখানে বাস করব। মূর্খেরা এভাবেই চিন্তা করে। শুধু জানে না, জীবন কখন কোথায় শেষ হয়ে যাবে।’
কথাগুলো আমার নয়। গৌতম বুদ্ধের।
সত্যিই কি আমরা জানি, আমাদের জন্য আগামীকাল কী অপেক্ষা করছে? জানি না। তবুও দিবানিশি ব্যস্ত থাকি জীবনের অজানা লংটার্ম তৈরির মিথ্যা এক মোহে। সম্ভবত এটাই জীবনের বাস্তবিক নিয়ম।
সেই নিয়মের আড়ালে অবিকল ভুলতে বসেছিলাম, আমাদের সবাইকে একদিন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। মানুষ ক্ষণজন্মা এক প্রাণী। তাই মানুষের উচিত মৃত্যু আসার আগেই এমন কিছু ভালো কাজ করে যাওয়া, যা তাঁর মৃত্যুর পরও মানুষ মনে রাখবে। মরেও সে হয়ে থাকবে অমর।
মৃত্যু অবধারিত সত্য। তাকে উপেক্ষা করার বা এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের কারওরই নেই। মৃত্যুতেই সব কর্মের অবসান। কিন্তু সেই মৃত্যু খুব নীরবে-নিভৃতে আসে। কাউকে জানান দিয়ে আসে না। তবু আমরা মৃত্যুকে ভুলে থেকে ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে মেতে থাকি, গর্ব করি, করি অহংকার।
এবার কিন্তু মৃত্যু বেশ সরবেই এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের চৌকাঠ অবধি। জানি বেঁচে থাকা আনন্দের। কিন্তু সেই আনন্দময় জীবনটাকে, প্রজাপতির পাখনার মতো রঙিন জীবনটাকে আজকাল বড় বিবর্ণ মনে হয়। মৃত্যুকে অহর্নিশ পাশাপাশি নিয়ে হাঁটছি আমরা এক চওড়া পথ। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও করছি কি মনে রাখার মতো কোনো মহৎ কাজ?
বরং বাবা হয়ে মর্গে ফেলে আসছি সন্তানের লাশ। বোন হয়ে ভাইকে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছি নীরবে। সন্তান হয়ে মাকে জঙ্গলে ফেলে আসছি রাতের অন্ধকারে। অসহায় বৃদ্ধ পয়সা মিটিয়ে হাসপাতাল ছাড়তে পারবে না বলে, ওঁর শুকিয়ে যাওয়া বয়স্ক খটখটে এক জোড়া পা রশি দিয়ে চোরের মতো বেঁধে রাখছি হাসপাতালের বেডে। প্রিয়তমা স্ত্রী হয়ে স্বামীকে ঘরের ভেতর মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করে মরতে দেখেও কাছে যেতে দেখছি না। এখানে–সেখানে পাখির মতো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে প্রাণহীন হিমশীতল দেহ।
একটাই ভয় সে মৃত্যুর ভয়। যদি আমাকেও স্পর্শ করে এই ভয়ংকর ভাইরাস। তাহলে তো আমিও মরে যাব। যারা কিনা মানুষের প্রাণ বাঁচায়, সেই ডাক্তার নামক সেবকেরাও প্রথম দিকে সরে দাঁড়িয়েছিল সেবার পথ থেকে। কারণ ওই একটাই, তা হলো মৃত্যু, যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি।
তা ছাড়া এ তো আর স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। মৃত্যু–পরবর্তী স্বাভাবিক গোসল, জানাজা, দাফন, এমনকি আপনজনের একফোঁটা চোখের পানি, একটুখানি স্পর্শ পাওয়ার মতো সৌভাগ্য তো আর হবে না করোনায় মৃত্যু হলে। তাহলে কেন আমরা ভয় পাব না বলুন? শুধু কী তাই, লাশটা পর্যন্ত স্বজনের কাঁধে চড়ে শেষবারের মতো নেওয়া হবে না কবরস্থানে। লাশের শরীর থেকেও ছড়াতে পারে এই প্রলয়ংকরী ভাইরাস। এমন ভিত্তিহীন ভাবনা ভর করেছে আমাদের প্রতিবন্ধী মস্তিষ্কে।
ভাবুন, কী অমানবিক হয়ে গেছি আমরা সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও। বাবার লাশ, মায়ের লাশ, এমনকি সন্তানের লাশও নামাতে পারছি না সযত্নে কবরে। নিজেকে আমরা কতটা ভালোবাসলে এমন নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতে পারি।
এমন ভয়াবহ মৃত্যু দেখেও কি এতটুকু বদলাতে পেরেছি নিজেদের? পারিনি। তার অগণিত প্রমাণ চারপাশজুড়ে। আমরা থেমে আছি কি পাপ-অনাচার-মিথ্যাচার—এসব অপকর্ম থেকে? মোটেও থেমে নেই। প্রতিনিয়ত ঠকিয়ে যাচ্ছি একে অপরকে। লুটপাট করছি একে অন্যের হক। সম্পদের লোভে মসজিদের ইমাম হয়েও বিশ্বাস করে আপন করে নেওয়া মানুষগুলোকে জবাই করছি অবলীলায়। আর ধর্ষণ! এ যেন রোজকার নিয়মে পরিণত হয়েছে। অথচ আমরা জানি, এসবের কিছুই মৃত্যু–পরবর্তী জীবনে কোনো সুফল বয়ে আনবে না। তাহলে কেন করোনায় আক্রান্ত মানুষকে এত ভয়, এত অবহেলা?
অদ্ভুত একটা ব্যাপার, গরিবেরা না হয় সচেতন নন অথবা তাঁদের উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা নেই; কিন্তু দেশের বড় বড় মানুষগুলো—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, শিল্পী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না কোভিড–১৯–এর মতো ভয়ানক ভাইরাস থেকে। উনারা কি সচেতন নন? মৃত্যু আসলে কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না। লাগে শুধু অছিলামাত্র। ধনী–গরিব জাতপাত কিছুই সে বোঝে না। সবাইকে নিতে হয় মৃত্যুর শীতল স্বাদ। তাহলে কী লাভ বলুন, সেই মাটির তৈরি মানুষ হয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে এত দাম্ভিকতা দেখানোর; বরং মাটির মতো হওয়াই কি সমীচীন নয়?
স্টিফেন হকিং বলেছেন, ‘মৃত্যু নিয়ে আমি ভীত নই। কিন্তু মরার জন্য তাড়াও নেই আমার। তার আগে করার মতো অনেক কিছু আছে আমার।’
সব গতি থেমে যাবে। বিলীন হয়ে যাবে সব অস্তিত্ব, ক্ষমতা, দাপট-হুংকার, সম্পদ- প্রতিপত্তি। শুধু কর্মই রয়ে যাবে ইতিহাস হয়ে মানবের তরে। কাজেই কী লাভ এত আমার আমার করে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে লড়াই করে। চলে তো যেতেই হবে শূন্য হাতে সবটা উজাড় করে রেখে। তাহলে? কী লাভ মন্দের ভাগীদার হয়ে। আগামীকাল আমি আপনি হয়ে যেতে পারি বেলা আড়াইটার শোক সংবাদ। কবে শেষ হবে এই অনাকাঙ্ক্ষিত আগামীকাল, বেলা আড়াইটার সেই প্রতীক্ষার প্রহর গুনি রোজ। তবে কেন হতে পারি না পরিপূর্ণ নিরেট এক সাদা মানুষ।
কোভিড–১৯ খুব করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, বেঁচে থাকা সুখের, আনন্দের, কিন্তু মৃত্যু চিরন্তন সত্য। তাই যতটুকু সময় পাও জীবনের জন্য তাকে ব্যয় করো মঙ্গলার্থে।
পাবলো নেরুদার কথাতেই শেষ করতে চাই, ‘তোমার আগে যদি আমার মৃত্যু হয় অথবা আমার আগে তোমার দেহান্তর, তবু যেন আমরা বেদনার সীমানা না বাড়াই; কারণ, বেঁচে থাকার মতো বিপুল আর তো কিছু নেই।’