নগরের মোড়ে মোড়ে মানুষের নাম

রাজশাহী নগরের বেশ কিছু মোড়ের নাম চা–বিক্রেতা, মুদিদোকানি ও রাজমিস্ত্রির নামে। সাধারণ পেশার এসব মানুষের নাম প্রতিনিয়ত শোনা যায় নগরের মোড়ে মোড়ে।

বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রাজশাহী নগরে হয়েছে দোশর মণ্ডল, হানুফা (ডানে ওপরে) ও হাদির মোড়ের (ডানে নিচে) নামকরণছবি: শহীদুল ইসলাম

রাজশাহী নগরের সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে দাঁড়ালেই কানে ভেসে আসে ‘এই সাধুর মোড়, কেদুর মোড়, হাদির মোড়, মোন্নাফের মোড়, মিজানের মোড়’। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালকদের মুখে মুখে এসব নাম থাকে সকাল থেকে রাত অবধি। শুধু শহরের প্রাণকেন্দ্র জিরো পয়েন্ট নয়, নগরজুড়েই বিভিন্ন যানের চালকদের কণ্ঠে শোনা যায় বিচিত্র সব স্থানের নাম। নামগুলো হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তির নামানুসারে।

যেসব ব্যক্তির নামে শহরের বিভিন্ন স্থানের নামকরণ হয়েছে, তাঁদের কেউ ছিলেন মুদিদোকানি, কেউ চা–বিক্রেতা, কেউ বা সবজি বিক্রেতা। তাঁদের নামে স্থানের নামকরণ নিয়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়ানো আছে নানা গল্প।

নগরের হানুফার মোড়ের নামকরণ হয়েছে হানুফা (৫৩) নামের একজনের নামে। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। নগরের বিনোদপুর থেকে দক্ষিণ দিকে গেলেই হানুফার মোড়। নামকরণের গল্প তিনি নিজেই শোনালেন। তিনি জানান, ১৯৮০ সালের কথা। এরশাদের শাসন চলছে। ঠিক সেই সময় ওই এলাকায় খাবার হোটেল দেন হানুফা। সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত খাবার খেতেন, মাঝেমধ্যে শিক্ষকেরাও আসতেন। এভাবে ওই এলাকার নাম হয়ে যায় হানুফার মোড়। তবে হানুফার এখন আর সেই খাবারের দোকান নেই। পরিবারেরও নেই তেমন সচ্ছলতা। ওই মোড়ের একটি কোণে তাঁর রয়েছে ছোট্ট একটি দোকান।

হানুফা বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কত ছেলেপুলেরে যে খাওয়াইছি। কখনো টাকা নিয়েছি, আবার নেইনি। ছেলেরা এলে দেখা করে, এটাই সবচেয়ে ভালো লাগে। আর আমার নামে একটি এলাকার নাম হয়ে গেছে। এটাই থাকবে একদিন।’

শহর রাজশাহীর আদিপর্ব বইয়ে গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী রাজশাহী নগরের বেশ কয়েকটি মোড়ের কথা উল্লেখ করেছেন। বইয়ে উল্লেখ করা মোড়ের নামকরণের ইতিহাসের সঙ্গে স্থানীয় ব্যক্তিদের বয়ানেরও মিল আছে। মাহবুব সিদ্দিকীর বইয়ে দোসর মণ্ডলের মোড়, গোরহাঙ্গা মোড়, সাধুর মোড়, মোন্নাফের মোড়, মকবুল হাবিলদারের মোড়, হাদীর মোড়, কেদুর মোড়, কালুমিস্ত্রির মোড়, আলুপট্টির মোড়, বটতলার মোড়, কাদের মণ্ডলের মোড়, বাল্লকপাড়া মোড়, আলেকের মোড়, হজর মোড়, মোহনলালের মোড়/বাটার মোড়সহ আরও বেশ কয়েকটি মোড়ের নামকরণের তথ্য পাওয়া যায়।

এসব মোড়ের কোনোটির নামকরণ হয়েছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে, আবার কোনোটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে-পরে। তবে ইদানীং আরও কিছু মোড়ের নাম শোনা যাচ্ছে। এই বইয়ের তালিকার বাইরেও রাজশাহী নগরজুড়ে পরিচিত আরও ৩০–৪০টির মতো মোড়ের সন্ধান পাওয়া যায়। গত ৫-১০ বছরেও বেশ কিছু মোড়ের নামকরণ করা হয়েছে।

রাজশাহী নগরের টিকাপাড়া সীমানার শেষ মাথায় রানীনগরের প্রথম মোড়টিই সাধুর মোড় নামে পরিচিত। মোড় পরিচিতির আগে এখানে একটি ছোট্ট মুদিদোকান ছিল। এর মালিক ছিলেন সাদু মিয়া। তিনি দোকানদারির পাশাপাশি এলাকায় মৃত ব্যক্তির জানাজা পড়াতেন। ছিলেন টিকাপাড়া কবরস্থানের খাদেম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থানীয় বাসিন্দারা এ জায়গার নাম রাখেন সাধুর মোড়। মুখে মুখে সাদু নামটি একসময় সাধু হয়ে যায়।

রানীনগর এলাকাতেই রয়েছে মোন্নাফের মোড়। মোহাম্মদ মোন্নাফের বাবার নাম আবদুস সালাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর ছেলে মোন্নাফ
চায়ের দোকান দেন। সে দোকানে প্রচুর মানুষের সমাগম হতো। সেই থেকে ওই এলাকার নাম মোন্নাফের মোড়।

নগরের রামচন্দ্রপুর এলাকায় রয়েছে কালুমিস্ত্রির মোড়। কালুমিস্ত্রি ছিলেন ৩০-৪০ দশকের রাজশাহী শহরের একজন খ্যাতিমান রাজমিস্ত্রি। তাঁর বাবাও ছিলেন মিস্ত্রি। কালুমিস্ত্রির হাতে শহরের একাধিক স্থাপনা নির্মিত হয়েছে।