নাম ‘মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি’। কিন্তু সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ৪০ সদস্যের কেউই প্রকৃত মৎস্যজীবী নন। তবু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জলমহালের ইজারা নিয়েছেন। বিধি ভেঙে তা অন্যজনকে ইজারাও দিয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ‘কোটালী-দর্শনা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামের এ সমিতির কাছে কোণঠাসা স্থানীয় প্রকৃত মৎস্যজীবীরা। ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁরা জেলা সমবায় দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তদন্ত শেষে দপ্তর ওই সমিতির সবাইকে ‘ভুয়া মৎস্যজীবী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গত ২০ অক্টোবর জেলা সমবায় কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগটি করেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের ফুরশেদপুর গ্রামের হাফিজুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, বাবুল আক্তার, আবদুল হালিম ও মহির উদ্দিন; যাঁরা নিবন্ধিত মৎস্যজীবী। অভিযোগে বলা হয়, অ-মৎস্যজীবীদের নিয়ে আলী আজগার ভুয়া মৎস্যজীবী সমিতি পরিচালনা করছেন। ওই সমিতির কারণে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
জেলা সমবায় দপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি, ২০০৯ অনুযায়ী, যিনি প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ শিকার ও বিক্রি করেই প্রধানত জীবিকা নির্বাহ করেন, তিনিই প্রকৃত মৎস্যজীবী। সে হিসাবে কোটালী-দর্শনা সমিতির একজনও প্রকৃত মৎস্যজীবী নন। সদর উপজেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির গত বছর প্রণীত তালিকায়ও তাঁদের কারও নাম নেই।
তবে সদর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহম্মেদের কাছ থেকে ওই ৪০ জনের নামে মৎস্যজীবী হিসেবে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, ওই ব্যক্তিদের প্রত্যয়নপত্র দিয়ে তিনি কোনো অনিয়ম করেননি। জাতীয় পরিচয়পত্র বা অন্য কোথাও তাঁদের পেশা হিসেবে মৎস্যজীবী উল্লেখ নেই, এটা ঠিক। তবে তাঁরা আদালতের মাধ্যমে অ্যাফিডেভিট করে মৎস্যজীবী পরিচয়ে দীর্ঘদিন সমিতি পরিচালনা এবং সরকারি জলমহাল ইজারা নিয়ে আসছেন।
জেলা সমবায় দপ্তর সূত্র জানায়, সমিতির সভাপতি আলী আজগার ২০১১ সালের আগস্টে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সদর উপজেলার ‘বেগমপুর বিল জলমহাল’ ইজারা নেন। ২৫টি শর্ত সাপেক্ষে জলমহালটি ছয় বছর মেয়াদে ইজারা দেওয়া হয়। ৯ নম্বর শর্ত ছিল, ইজারাগ্রহীতা জলমহালটি অন্য কাউকে ইজারা দিতে পারবেন না। দিলে লিজ তাৎক্ষণিক বাতিল বলে গণ্য হবে। কিন্তু সভাপতি আজগার ২০১২ সালের ১৭ জুন জলমহালটি পাশের তিতুদহ গ্রামের আবদুল্লাহ আল মামুনের কাছে ইজারা দেন। সেই থেকে তিনিই জলমহালে মাছ চাষ করছেন।
আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ইজারা নেওয়ার সময় আলী আজগারকে তিনি এককালীন ৭ লাখ টাকা দেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রতিবছর ইজারামূল্য পরিশোধের পাশাপাশি আলী আজগারকে মুনাফা হিসেবে আরও আড়াই লাখ টাকা করে দিয়ে আসছেন।
সমিতির পাঁচজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের নামমাত্র সদস্য রাখা হয়েছে। ইজারা দিয়ে গত ছয় বছরে পাওয়া ১৫ লাখ টাকা সভাপতি একাই ভোগ করেছেন। এমনকি সমিতির আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাবও তাঁরা জানেন না। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সমিতির তহবিলে মাত্র আট টাকা স্থিতি দেখানো হয়েছে।
জেলা সমবায় দপ্তর সূত্র আরও জানায়, অভিযোগ তদন্তে তারা গত ২৪ অক্টোবর তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে তদন্ত শেষে ২৭ অক্টোবর প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে বলা হয়, সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ একজনও প্রকৃত মৎস্যজীবী নন। সভাপতি নিজে রাজমিস্ত্রির ঠিকাদার। অন্যরা দিনমজুর, কৃষক, মসজিদের ইমাম, কাঠ ব্যবসায়ী, ইটভাটার শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। তাঁদের মধ্যে চাকরিসূত্রে দুজন ঢাকায় এবং একজন ঝিনাইদহে অবস্থান করেন। তিন বছর আগে মৃত একজনকেও সমিতির সদস্য দেখানো হয়েছে।
তবে সভাপতি আলী আজগার দাবি করেছেন, তিনিসহ সমিতির সবাই প্রকৃত মৎস্যজীবী। তিনি বলেন, ‘২০০৪ সাল থেকে সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমে তিন দফায় জলমহাল ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করে আসছি। একটি বিশেষ মহলের প্ররোচনায় সমবায় দপ্তর মনগড়া প্রতিবেদন দিয়েছে।’ অন্য ব্যক্তিকে ইজারা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের এক নেতা চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে ইজারা দিতে বাধ্য করেছেন।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. মনজুর কাদের বলেন, ভুয়া মৎস্যজীবীদের নিয়ে গঠিত ওই সমিতির নিবন্ধন বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাতিল হলে সমিতি সব ধরনের জলমহাল ইজারা নেওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।