নির্বাচনের আগে শহর নারায়ণগঞ্জের ‘হৃদয়ে’র খোঁজে
এ যেন ঢাকার মতোই আরেকটি শহর। ছোটখাটো আরেকটি ঢাকা; কিংবা বলা যেতে পারে, চরিত্রগত দিক থেকে ঢাকার গুলিস্তানের একটি বর্ধিতাংশ। আমি এসেছি শহর নারায়ণগঞ্জে এর হৃদয়টাকে বুঝতে। তৃতীয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মোটে ছয় দিন আগে।
২৫ পৌষের ‘গনগনে’ দুপুরে (ঢাকার তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া মোড়ে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এ এক জমজমাট নির্বাচনের নগরী। মেয়র ও কাউন্সিলরদের পোস্টার হাজার হাজার। একটু পরপর মিছিল যাচ্ছে কাতারে কাতারে।
যানজট এ শহরের ভূষণ। রিকশা, অটো (ব্যাটারি ও সিএনজিচালিত), মিনিবাস, মিনিট্রাক, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলের অনবরত হর্ন যেন এখানকার মানুষের গা সওয়া। পুরো শহর ও বন্দর (কদম রসুল) ঘুরে সাধারণের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করব, এই হলো মোটাদাগে উদ্দেশ্য।
৫ লাখ ১৭ হাজার ভোটার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। আর এ শহরের বাসিন্দা প্রায় ২০ লাখ। তবে ভোর থেকে গভীর রাত অবধি এ শহরে যাওয়া–আসা করে আরও দ্বিগুণ, আড়াই গুণ মানুষ। তাই দিনের বেলা এ শহরে মানুষের সঙ্গে মানুষ যেন গায়ে গায়ে বাড়ি খায়।
‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’খ্যাত এ শহরে জিনিসপত্রের দামও একটু বেশি। চাষাঢ়ার ‘শহীদ জিয়া হল মার্কেটে’র ফলবিক্রেতার ভাষ্য, ‘সবকিছুতে ঢাকার চেয়ে নারায়ণগঞ্জে খরচ ১০ টাকা বেশি।’
ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১২টা বেজে ৫ মিনিট। এর মধ্যেই মিছিলের শব্দ। কে যেন বললেন, হাতি মার্কার মিছিল আসছে। অমনি চোখ চলে যায় সড়কের এপার-ওপার সুতায় ঝোলানো হাতি মার্কার হাজারো পোস্টারের দিকে। হাতি মার্কার প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার, যিনি নামের আগে বিশেষণ যোগ করেছেন ‘মজলুম জননেতা’। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পদ থেকে প্রত্যাহার হওয়া তৈমুর নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ‘জনগণের মনোনীত মেয়র প্রার্থী’ হিসেবে। আর পোস্টারে লিখেছেন, ‘তৈমুর আলম এলে এবার, নগর ভবন হবে সবার।’
এর মধ্যে শ দেড়েক নেতা–কর্মী নিয়ে তৈমুরের গণসংযোগ মিছিল হাজির। জায়গাটি নবাব সলিমুল্লাহ রোডের খানপুর ডন চেম্বার। ভিড় ঠেলে মুখোমুখি হই ৬৮ বছরের তৈমুরের সঙ্গে। তাঁর কথা, নগরবাসীর গৃহকর, পানির বিল বাড়ানো হয়েছে অন্যায্যভাবে। সেভাবে বাড়েনি নাগরিক সুবিধা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বল অবস্থা। গরিব হকারদের উচ্ছেদ করে পেটে লাথি মারা হয়েছে। এ অবস্থায় তিনি এমন নগর প্রশাসন গড়তে চান, যা হবে সাম্যের ও সবার। নিজের ভাষায় তিনি ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল ও অব দ্য পিপল’–এর প্রার্থী।
প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসির সাবেক চেয়ারম্যান তৈমুর বলেন, ‘আইনবহির্ভূতভাবে বড় বড় নৌকা বানানো হচ্ছে, বড় বড় গেট বানানো হচ্ছে। আমরা দুটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু আমাদের অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন অন্ধ ও বোবা।’
মুহূর্তেই হাজির স্থানীয় ও ‘কেন্দ্রীয়’ বিভিন্ন গণমাধ্যমের অন্তত দুই ডজন কর্মী। সঙ্গের নেতা–কর্মীরা তৈমুরকে তাড়া দিচ্ছিলেন। কারণ, প্রায় ১৫ মিনিট পার হয়ে গেছে। আরও একাধিক জায়গায় গিয়ে ‘হাত মুসাফা’ করা বাকি রয়ে গেছে! যাওয়ার আগে কী মনে করে সদ্য সাবেক এই বিএনপি নেতা বলে গেলেন, ‘আজ যদি আলী আহমদ চুনকা (মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা) বেঁচে থাকতেন, তিনিও আমার নির্বাচন করতেন। কারণ, আমরা ভাই ও রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলাম।’
শহর নারায়ণগঞ্জ একসময় নানা কিছুর জন্য বিখ্যাত ছিল। এর একটি বোস কেবিন, যেটি এখন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছে। তবে এখনো জমজমাট জগৎবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডার। শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু রোডে এ দোকানের সামনে তখনো ১০ জনের মতো ক্রেতা লাইনে দাঁড়িয়ে। কারণ, ‘দুপুরের পর এই মিষ্টি আর পাওয়া যায় না’।
এ লাইন থেকে বছর পঁচিশের এক তরুণের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। কানটুপি পরে দাঁড়ানো ছেলেটি সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে সন্দিহান। তাঁর যুক্তি, ‘জেলা প্রশাসক সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাওয়ায় তাঁকে সরে যেতে হচ্ছে।’ যদিও নির্বাচনের পরপরই তাঁর নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
জগৎবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডারের ঠিক সামনেই সড়কের প্রধান সড়কের কোনায় আবর্জনার স্তূপ। এ শীতকালেও ড্রেনের পানি উপচে সড়কের ওপরে। এ দৃশ্য বলে দেয় শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার চিত্র।
এবার যাব মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর গণসংযোগস্থলে। সঙ্গে আছেন প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি মজিবুল হক। খবর পাওয়া গেল সেলিনা হায়াৎ আইভী আছেন শীতলক্ষ্যা নদীর ওপার বন্দর এলাকায়। বন্দর, সিদ্ধিরগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ পৌরসভাকে একীভূত করে গঠিত হয়েছিল সিটি করপোরেশন ২০১১ সালে। এর পর থেকে টানা দুই মেয়াদে নির্বাচিত মেয়র আইভী। এবার তৃতীয় মেয়াদে প্রার্থী তিনি। ২০০৮ সালে পৌরসভায় নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।
যে পৌরসভায় সত্তরের দশকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন আইভীর বাবা আলী আহমদ চুনকা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি। হারিয়ে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী, ওসমান পরিবারের সমর্থনপুষ্ট খোকা মহিউদ্দিনকে।
আমরা শীতলক্ষ্যার ঘাটে চলে এসেছি। বর্জ্যে দূষিত কৃষ্ণকায় পানির শীতলক্ষ্যা। ঘাটে নৌকা, ট্রলার শয়ে শয়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, দিনে লক্ষাধিক মানুষ পারাপার হয়। নৌকায় মোটরসাইকেল উঠিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওপারে পৌঁছানো গেল।
সকাল থেকেই বন্দরে গণসংযোগে মেয়র। ২৭ ওয়ার্ডের সিটি করপোরেশনে এখানে নয়টি ওয়ার্ড। নারায়ণগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে ৯টি করে বাকি ১৮টি।
এর–ওর কাছে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, আইভী আছেন ২২ নম্বর ওয়ার্ডের খানবাড়ি এলাকায়। সেখানে বিপুল নেতা–কর্মী–সমর্থক নিয়ে একটি অটোতে বসে, সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী শাওন আকন্দকে পাশে বসিয়ে গণসংযোগে ব্যস্ত রয়েছেন। এখানেও ক্যামেরার অনবরত ফ্ল্যাস, রেকর্ড অন করে মুঠোফোন মুখের সামনে বাড়িয়ে দেওয়া।
আইভীর মুখে শুরুতেই তৈমুর আলম খন্দকারকে ‘কাকা’ সম্বোধন করে সম্মান। এরপর প্রতিপক্ষ হিসেবে আক্রমণ, ‘সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও মানুষের প্রার্থী। আর তিনি শামীম ওসমানের প্রার্থী।’
দলীয় মনোনয়ন পেয়েও অনেকটা এককভাবে লড়াই করতে হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিনা হায়াৎ আইভীর উত্তর, ‘এমন প্রশ্ন আসা ঠিক নয়। দল আমার পাশে আছে। মানুষের সমর্থন আমার সঙ্গে আছে।’ তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘নারী ভোটাররা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের ভোট আমি পাব। উন্নয়নকাজের জন্য সব মানুষের ভোট আমি পাব।’
সমর্থকদের ভাষ্য, শহরে আইভী অনেক উন্নয়নকাজ করেছেন। বিশেষ করে অলিগলির সড়ক সংস্কার ও নির্মাণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলাশয়, পুকুর সংরক্ষণ, পার্ক নির্মাণ করে বিনোদনের ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য। শহরে গ্যাস ও পানির সমস্যা আছে, কাজটি যদিও সিটি করপোরেশনের নয়, তবু সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনবরত যোগাযোগ রেখে চলেছেন মেয়র আইভী। বাকি কাজ শেষ করার জন্য ভোটাররা আইভীকেই বেছে নেবেন।
ঘাটে ফিরে এসে আবার সেই মো. মামুনের সঙ্গে দেখা, যার নৌকায় এপারে (বন্দরের দিকে) এসেছিলাম। এক ঘণ্টায়ও কোনো খেপ পাননি। ঘাটে নৌকা চলে সিরিয়াল মেনে। সারা দিনে খেপ হয় চার–পাঁচটা। দিনে আয় ৪০০–৫০০ টাকা। মুঠোফোন নম্বর চাইলে ফোকলা হেসে বললেন, ‘মুখস্থ নেই’।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হয়ে যাওয়ায় শীতলক্ষ্যায় শিগগিরই সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হবে। তখন পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়বেন মামুনের মতো বংশপরম্পরায় নৌশ্রমিকেরা।
শহরে ফিরে এসে আবার নির্বাচনের চিত্রটি বুঝতে চেষ্টা করি। একসময় শ্রমিক লীগের রাজনীতি করতেন, এখন গার্মেন্টসের ‘স্টক লট’-এর ব্যবসা করেন, সেই মো. ওবায়দুল হক বললেন, ২০১৬ সালের নির্বাচনেও এমন পরিস্থিতি হয়েছিল। সেবার যে ফলাফল হয়েছিল, এবার তাঁর ব্যতিক্রম হবে না বলে তাঁর ধারণা। তিনি বললেন, বিএনপির প্রকৃত সমর্থকের ভোট হাতি মার্কার প্রার্থী পাবেন না।
ভিন্নমতও আছে। দীর্ঘ সময় জেলায় একটি পেশাজীবী সংগঠনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এমন একজন বললেন, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সাংসদ যে বিভেদের কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছেন, তাতে কিছু রক্ত ঝরতে পারে।
স্থানীয় আরেকটি সূত্র বলছে, এ নির্বাচনে নৌকা বিরোধীরা একজোট হয়ে গেছে। সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় হেফাজতে ইসলামের সমর্থন রয়েছে, তাঁদের ভোট হাতি মার্কায় যেতে পারে। ব্যক্তি তৈমুরের গ্রহণযোগ্যতার কথাও বললেন কেউ কেউ।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা রোববার নারায়ণগঞ্জে ছিলেন। তিনি বলছিলেন, সবার ওপরে হচ্ছে মেয়র আইভীর লড়াই। সাধারণ ভোটাররা তাঁর এই লড়াকু মানসিকতাকে পছন্দ করে। এবারও করবে বলে তাঁরা আশাবাদী।
সময় যত গড়ায়, শহরের যানজট ততই বাড়তে থাকে।
শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু রোডের বিভাজকে রোপণ করা গাছগুলো বেশ ডালপালা মেলে পাতা ছড়িয়েছে। এই সবুজ রং তারুণ্য ও উৎসাহের প্রতীক। শহরের হৃদয় খুলে বোঝা গেল, ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে উৎসবমুখরতা ও ভোটের জয় দেখতে চান স্থানীয় মানুষেরা।