পাথারিয়া পাহাড়ে মায়াবী নীলবাসক।
ছবি: লেখক

অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা ছিলেন চার্লস ডারউইনের ভাবশিষ্য। এতটাই যে ডারউইনকে ঘিরে রচনা করেছিলেন তিন-তিনটি বই। এমন অনুরক্তি থেকেই তিনি গিয়েছিলেন সাড়া জাগানো এই প্রকৃতিবিদের জন্মভিটা ইংল্যান্ডের শ্রুসব্যারিতে। কিন্তু আমার সাধ থাকলেও সাধ্যে ততটা কুলায়নি। আমি গিয়েছি আমার উদ্ভিদবিদ্যার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার প্রকৃতিদর্শনের আঁতুড়ঘর পাথারিয়া পাহাড়ে।

পারিবারিক সূত্রে পাওয়া একটি অনুচ্চ টিলা ও লাগোয়া পাহাড়ে ছেলেবেলায় দিনমান ঘুরে বেড়ানো দ্বিজেন শর্মার বাস্তুবিদ্যার হাতেখড়িও এখানেই। পাথারিয়ার এই স্বপ্নবোনা প্রকৃতির আবেগঘন বয়ান তাঁর লেখায় বারবার ফিরে এসেছে। এই বন আমৃত্যু তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিল। ‘কতিপয় সুদর্শন বনবৃক্ষ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমার কৈশোর কেটেছে সিলেটের পাথারিয়া পাহাড়ের লাগোয়া অরণ্যঘেরা অঞ্চলে। সেখানকার গাছগাছালি-পাখপাখালি যে মনের গভীরে কতটা ছায়া বিস্তার করেছিল, একদিন টের পেলাম, যখন হঠাৎ মনে পড়ে, কবে কখন একটি লাল রঙের পাখি দেখেছিলাম ওই জঙ্গলে, নিশ্চিতই আলতাপরি, স্কারলেট মিনিভেট, আর সারা দিন সে আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল, কোনো কাজেই মন বসানো গেল না। আরেক দিন মনে পড়ল একটি গাছের কথা, বেশ বড়সড়, লম্বা চ্যাপ্টা পাতা, ফুলগুলোও ঢাউস, বহু পাপড়ির, হয়তো ম্যাগনোলিয়ার কোনো প্রজাতি। বুনো ম্যাগনোলিয়া? অবিশ্বাস্য। বইপত্র খুঁজে হদিস মেলে। হ্যাঁ, বুনো ম্যাগনোলিয়াই বটে, দুলিচাঁপা, যার খোঁজ দীর্ঘদিন পাইনি।’ সুতরাং এমন একটি প্রকৃতি–তীর্থভ্রমণ আমাদের জন্য কতটা অপরিহার্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বর্ণখচিত এই পাহাড়ে না গেলে উদ্ভিদ অনুসন্ধানে অপূর্ণতা থেকেই যেত।

টিলায় ওঠার আগে সরু পথের ধারে রামবাসকের বনে যে অগ্নিরাঙা শোভায় চোখ জুড়িয়েছি, তার কোনো তুলনা হয় না। রামবাসকের এমন প্রাচুর্য আর কোথাও দেখিনি। ঢালে পেলাম দুর্লভ কালিকোরা এবং ঢাকিজামের গাছ। অনেক অচেনা গাছের ভিড়ে চোখ খুঁজছিল বড় পাতার সুউচ্চ এক বৃক্ষ। টিলার অন্য প্রান্তে পেয়ে গেলাম সেই গাছ, দুলিচাঁপা। তখন বনতলে অজস্র তৃণগুল্মের ভিড়ে চোখ আটকে গেল স্নিগ্ধ শোভার এই মায়াবী ফুলে। একেবারেই অচেনা। পাপড়ির গড়ন অনেকটা নয়নতারা ফুলের মতো। তবে রং ও পাতার গড়ন আলাদা। টিলার এক প্রান্তে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি গাছ দেখা গেল। আসলে প্রস্ফুটন মৌসুম ব্যতীত উদ্ভিদটি সাধারণত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। ফুলের ছবি দেখে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরদার নাসির উদ্দিন জানালেন, এটি অ্যাকেথাসিয়া পরিবারের ইরানথেমাম এসপিপি প্রজাতির উদ্ভিদ। ইংরেজি নাম ইস্ট-হিমালয়ান ইরানথেমাম। স্থানীয়ভাবে নীলবাসক নামেও পরিচিত।

পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের ঝোপালো এই উদ্ভিদ তিন থেকে চার ফুট উঁচু হতে পারে। কাণ্ড ঈষৎ লোমশ। এক থেকে দুই ফুট উঁচু ফুলের একক স্পাইক খাড়া ধরনের। শাখাগুলো তীক্ষ্ণভাবে ৪-পার্শ্বযুক্ত। পাতা ফ্যাকাশে সবুজ, প্রায় ১০ সেন্টিমিটার লম্বা, মসৃণ, চকচকে, প্রান্ত কুঁচকানো বা ঢেউখেলানো এবং শিরাযুক্ত। গাঢ় নীল রঙের ফুলগুলো বড়, বিকল্প জোড়াগুলোর বিপরীতে থাকে, যা স্পাইকটি দীর্ঘায়িত হয়ে দূরবর্তী হয়ে যায়। শাখাবর্তী মঞ্জরি ঢাকনা গাঢ় সবুজ এবং প্রায় আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা। গোড়ার দিকে নলাকার, পাতলা, মখমল-লোমশ এই ফুলের মুখের দিকে সামান্য বাড়ানো এবং বাইরের খাঁজ দৈর্ঘ্যের দ্বিগুণ হতে পারে। নীলবাসকের প্রাকৃতিক আবাস হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত। ফুল ফোটার মৌসুম জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত।