নোয়াখালীতে গত ১৩ মে থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেছে তিনটি। এসব অস্ত্রবাজির ঘটনায় সাতজনের মধ্যে ধরা পড়েছেন দুজন। ঘটনার পর মামলাও হয়েছে, মাসের পর মাস গেছে কিন্তু চার অস্ত্রধারীকে এখনো শনাক্তই করতে পারেনি পুলিশ। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটা তিন ঘটনাতেই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের কর্মীরা জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম নগরে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করা দুই ছাত্রলীগ নেতা ও এক কলেজছাত্রকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গত প্রায় ৩ বছরে ৯টি অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। এতে অস্ত্র হাতে দেখা যায় ১৪ জনকে। এর মধ্যে শনাক্ত হন ৯ জন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার ছয়জনই জামিনে রয়েছেন।
আবার গত ৩০ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ শহরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংঘর্ষ চলাকালে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সংঘর্ষে অংশ নেওয়া তিনজনের একজনকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এই তিনজনই যুবলীগের কর্মী।
নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার করালিয়া এলাকায় গত বছরের ১৩ মে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীদের অস্ত্র হাতে গুলি ও ধাওয়া করে কাদের মির্জার অনুসারী দুই অস্ত্রধারী সহিদ উল্যাহ ওরফে কেচ্ছা রাসেল (২৯) ও আনোয়ার হোসেন ওরফে পিচ্চি মাসুদ (২৬)।
অপর দিকে গত ৫ সেপ্টেম্বর জেলা শহর মাইজদীর জামে মসজিদ মোড় এলাকায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শিহাব উদ্দিনের অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি হামলা-ধাওয়ার ঘটনার সময় চারজনকে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। ওই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
গত ২০ নভেম্বর রাতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খানের বাড়িতে হামলার ও গুলির ঘটনায় সময়ও অস্ত্র হাতে মুখোশ পরা দুই সন্ত্রাসীকে দেখা যায়। ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে খিজির হায়াত খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অস্ত্রধারীদের একজন মো. মানিক (৩০), আরেকজন পিচ্চি মাসুদ বলে শনাক্ত করেন। ওই ঘটনায় খিজির হায়াত খানের স্ত্রী বাদী হয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলা করেন। এরপর গত ৩০ জানুয়ারি উপজেলার মুছাপুর এলাকা থেকে পিচ্চি মাসুদকে গ্রেপ্তার করে থানা-পুলিশের একটি দল।
বসুরহাটের ঘটনার চার মাস পর গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে সিরাজপুর ইউনিয়নের লোহার পোল এলাকার শ্বশুরবাড়ি থেকে কেচ্ছা রাসেলকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কিন্তু গ্রেপ্তার এই দুজনের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি সাজ্জাদ রোমেন প্রথম আলোকে বলেন, ভাইরাল হওয়া ভিডিওর দুই অস্ত্রধারী কেচ্ছা রাসেলের বিরুদ্ধে থানায় থাকা অস্ত্র মামলাসহ অন্যান্য মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। আর পিচ্চি মাসুদকে রিমান্ডে নেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন জানানো হয়েছে। আবেদনের শুনানি এখনো হয়নি।
অপর দিকে গত ৫ সেপ্টেম্বরের ঘটনা প্রসঙ্গে সুধারাম থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই ঘটনায় (অস্ত্র হাতে গুলির) সম্ভবত কোনো মামলা হয়নি। আর কেউ শনাক্ত হয়ে থাকলে কিংবা ধরা পড়লে আমি জানতাম। মনে হয় এ রকম কেউ ধরা পড়েনি।’
চট্টগ্রামে অস্ত্রধারী ২ ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার হননি
গত বছরের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের দিন পাথরঘাটা এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় গুলি ছুড়তে থাকা পিস্তল হাতে নগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি আ ফ ম সাইফুদ্দিনের ছবি বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে এখনো খুঁজে পায়নি।
এর আগে গত ১২ জানুয়ারি পাঠানটুলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হন আজগর আলী নামের এক মহল্লা সরদার। দুটি ঘটনার ভিডিও পুলিশ উদ্ধার করলেও অস্ত্রধারী শনাক্ত হয়নি।
আর ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী বিবি মরিয়মের পক্ষে চার যুবক প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করেন। ওই চার অস্ত্রধারীর মধ্যে রাকিব হায়দার এমইএস কলেজের ছাত্র, তাঁর হাতে ছিল পিস্তল। অস্ত্রধারী আরেক যুবক মাহমুদুর রশিদ ওরফে বাবু, তিনি নগর ছাত্রলীগের সদস্য। বাকি দুজনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৯টি অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা ঘটে নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তার, জায়গা ও কবরস্থান দখল এবং ট্রাকস্ট্যান্ডের চাঁদাবাজি নিয়ে। এ নিয়ে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে ‘অস্ত্রধারীরা ধরা পড়ে না’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর ছয়জন গ্রেপ্তার হন। তবে তাঁরা সবাই এখন জামিনে।
এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ ইতিমধ্যে অস্ত্রধারীদের অনেককে ধরেছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। কে কোন দলের, সেটি আমাদের কাছে বিবেচ্য নয়। অস্ত্রধারীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করবেই।’
সিরাজগঞ্জে অস্ত্রবাজ গ্রেপ্তার হননি
গত ৩০ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ শহরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংঘর্ষ চলাকালে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সংঘর্ষে অংশ নেওয়া তিন যুবলীগ কর্মীর মধ্যে সুমন হোসেন (২৪) ও জনি হাজামকে (২৩) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বায়েজিদ আহমেদ নামের অপর একজনকে চিহ্নিত করা গেলেও তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন (সিরাজগঞ্জ সদর সার্কেল) প্রথম আলোকে বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এই সংঘর্ষের ঘটনায় সিরাজগঞ্জ সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোস্তাফিজুর রহমান, আলীম হোসাইন ও মাহমুদ হাসান বাদী হয়ে তিনটি এবং আওয়ামী লীগ কর্মী ও ছাত্রলীগ নেতারা আরও তিনটি মামলা করেছেন। এসব মামলায় জ্ঞাত-অজ্ঞাত প্রায় সাড়ে আট শ বিএনপি নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সদর থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, এসব মামলায় পুলিশ এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই।
জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুনর রসিদ খান প্রথম আলোকে জানান, পুলিশ, আওয়ামী লীগ কর্মী ও ছাত্রলীগ নেতাদের করা মামলায় জেলা বিএনপির সহসভাপতি নাজমুল হাসান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল হাসান রঞ্জনসহ ১৬ নেতা-কর্মীকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী এবং প্রতিনিধি, সিরাজগঞ্জ)