কালনী এক্সপ্রেস দ্রুতগতিতে ছুটছে সিলেটের দিকে। তবে সিলেটের কাছাকাছি এসে হঠাৎ গতি কমে গেল। একপর্যায়ে একেবারে থেমে যাওয়ার অবস্থা। মধ্যরাতে এমন ঘটনায় কিছুটা উদ্বিগ্ন যাত্রীরাও। বগির জানালা দিয়ে দেখা গেল, রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে একজন টর্চের আলো ফেলেছেন ট্রেনচালকের বগিতে। চালক হাত বাড়িয়ে একটা কিছু নিলেন। কিছুক্ষণ বাদে সেটি ফেরত দিলেন। ট্রেনটি ধীরে ধীরে ফিরল স্বাভাবিক গতিতে।
এ বর্ণনা গত বুধবার অপরাহ্ণে ঢাকা থেকে সিলেট আসা এক ট্রেনযাত্রীর। তিনি পরদিন প্রথম আলোর সিলেট কার্যালয়ে ফোন করেন। ওই যাত্রীর আশঙ্কা, মধ্যরাতে এভাবে ট্রেন থামিয়ে অবৈধ কোনো কিছু ঘটতে পারে। তিনি বিষয়টি খোঁজ নেওয়ার অনুরোধ করেন। আসলেই সেখানে কী ঘটছে, সেই রহস্য লুকিয়ে আছে এক রেলসেতুর গল্পের আড়ালে।
সেতুটির অবস্থান সিলেট রেলস্টেশন থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে; দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজারের বিগারপুল এলাকায়। সেতুর এক পাশে একটি বিল, অপর পাশে নদী। এ নদী গিয়ে মিলেছে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে। গত মার্চ মাসের শুরুতে কুশিয়ারায় পাহাড়ি ঢল নামলে সেতুর দুটি খুঁটি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তখন জরুরি ভিত্তিতে সেতুর পিলার ও লোহার খুঁটির নিচে বালুর বস্তা ফেলা হয়। রেললাইনের দুই পাশে বাঁশ ফেলে রাখা হয়।
অস্থায়ী পাহারা
মার্চে বন্যার প্রথম তোড়েই সেতুটির দুটো পিলারগোড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ওই সময় থেকে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সেতুর ওপর দিয়ে পাহারায় ট্রেন পারাপারের কার্যক্রম শুরু হয়। এই আট মাস ধরে এভাবেই পারাপার হচ্ছে ঢাকা-সিলেট পথের সব ট্রেন। এই পথে এটিই একমাত্র পাহারায় ট্রেন পারাপারের ব্যবস্থা বলে বাংলাদেশ রেলওয়ের (পথ) প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়।
গত বৃহস্পতিবার দুপরে সরেজমিনে দেখা গেছে, লাল পতাকা হাতে সেতুর এপার-ওপারে সতর্ক অবস্থান পাহারাদারের। ট্রেন যখন সেতুর কাছাকাছি আসছে, তিনি লাল পতাকা নেড়ে গতি কমানোর নির্দেশনা দিচ্ছেন। গতি কমলে ট্রেনচালকের বগির কাছে গিয়ে পাহারাদার নিরাপদে পারাপারের জন্য একটি টোকেন দিচ্ছেন। ট্রেনচালক সই করে টোকেনটি ফেরত দেওয়ার পর সতর্কতার সঙ্গে সেতু পাড়ি দিচ্ছেন। সেতুটি লক্কড়-ঝক্কড় হওয়ায় ট্রেন গতি কমিয়ে চললেও অনেকটা ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ট্রেনযাত্রীরা উদ্বেগ নিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন।
ঘটনার সময় পাহারাদারের সঙ্গে ছিলেন সেতুর পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক যুবক। তিনি বললেন, ‘এইটা তো একটা কঠিন পারাদারি (পাহারা)। একটু উনিশ-বিশ হইলেই সর্বনাশ ঘটব। একেকটা ট্রেন যখন যায়, তখন পুলের (সেতু) মতো বুকটাও কাঁপে।’
পাহারায় নিযুক্ত ব্যক্তির নাম আবুল মিয়া (৫৫)। তিনি ফেঞ্চুগঞ্জের বাসিন্দা। রেলওয়ের প্রকৌশল (পথ) বিভাগ তাঁকে মাসিক বেতনে এ কাজে নিযুক্ত করেছে। কিন্তু দিনে ও রাতে পালা করে পাহারা দিতে হয়। ফলে আবুল তাঁর ছেলে এবং এক কিশোরকে সঙ্গে নিয়েছেন।
পাহারাদার আবুল মিয়া জানালেন, এ দায়িত্ব কেউ নিতে চাচ্ছিল না। তিনি সেবাব্রতী হয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন। সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে কাজটা করতে হয় বলে দুজনকে সঙ্গী করেছেন। সেতু দিয়ে কত দিন এভাবে পাহারায় ট্রেন পারাপার হবে? উত্তর জানা নেই আবুল মিয়ার।
ঢাকা-সিলেট রেলপথের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও স্টেশন থেকে ছাতক স্টেশন পর্যন্ত তদারকির দায়িত্বে থাকা রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলীর (পথ) দপ্তর সেতুতে এই পাহারা ও পরবর্তী সংস্কার কার্যক্রম তদারক করছে। এই দপ্তর সূত্র বলছে, পাহারায় সেতু পারাপারের বিষয়টি রেলওয়ে বিভাগের প্রচলিত একটি অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা। বন্যায় তিনটি পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেতুটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। সেতুর নিচে পানি না সরলে পিলার সংস্কারকাজ শুরু করা যাচ্ছে না। এ জন্য আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত অস্থায়ী ব্যবস্থা চলবে। এর আওতায় পাহারার মাধ্যমে সব ট্রেনকে সেতু পাড়ি দিতে ১০ কিলোমিটার গতিতে চলার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) ডিএম বাকি আবদুল্লাহ দাবি করেন, ওই সেতু দিয়ে ট্রেন এ গতিতে চললে কোনো ঝুঁকি নেই। ট্রেনের গতি সর্বনিম্ন রাখতে পাহারাদারের মাধ্যমে সতর্ক করার পাশাপাশি সিলেট থেকে মাইজগাঁও স্টেশন পর্যন্ত প্রযুক্তির সহায়তায় নজরদারি করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। উপসহকারী প্রকৌশলী বলেন, ‘এতে করে ওই সেতু এলাকা শুধু পাহারাদারনির্ভর নয়। আট মাস ধরে তো এভাবেই চলছে। তাতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা হয়নি। আমরা আশা করছি, আগামী দুই-তিন মাসে কিছু হবে না।’
তবে এতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না সেতুর আশপাশ এলাকার বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, সেতু দিয়ে যখন ট্রেন যায়, বিকট শব্দ হয়। তখন সেতুর কাছাকাছি থাকা লোকজন তটস্থ থাকেন। মোগলাবাজারের রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী আবদুল মালেক বললেন, ‘এভাবে চললে তো ঠিক আছে। আর ভাঙি গেলে কিন্তু রেলসহ পড়ব। তখন বড় অঘটনই ঘটব।’