পূর্ব ইউরোপের জঙ্গলে দলে দলে বাংলাদেশি

  • বসনিয়ায় জঙ্গলে বাংলাদেশিসহ ৫০০ জন।

  • স্লোভেনিয়ায় এ সপ্তাহে আটক শতাধিক।

বসনিয়া হার্জেগোভিনার ভেলিকা ক্লাদুসার বনে আশ্রয় নিয়েছেন অভিবাসনপ্রত্যাশী কয়েকজন বাংলাদেশি। এ দৃশ্য গত বুধবারেরছবি: রয়টার্স

ইউরোপ যাওয়ার জন্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে বাংলাদেশিদের মৃত্যু এখন আর নতুন খবর নয়। মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে এই ভয়ংকর যাত্রা এবং মৃত্যুর খবর বছর পাঁচেক ধরে প্রায় নিয়মিত গণমাধ্যমে আসছে। মানব পাচারের এখন নতুন পথ হিসেবে আলোচনায় এসেছে মধ্য ইউরোপের দেশ বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও স্লোভেনিয়া।

এই দুটি দেশের জঙ্গলে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে বাংলাদেশিসহ ছয় শতাধিক অভিবাসনপ্রত্যাশীর আটকা পড়ার খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এপি। তবে তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা কত, সেটা উল্লেখ করা হয়নি। মানব পাচারকারী চক্রগুলো এই ব্যক্তিদের বিভিন্নভাবে ক্রোয়েশিয়া হয়ে বসনিয়া বা স্লোভেনিয়ায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিসহ ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশগুলোতে পাঠাতে ভাগ্যান্বেষী এসব মানুষকে বিপজ্জনক যাত্রায় নামিয়েছে পাচারকারীরা।

ভূমধ্যসাগর হয়ে মানব পাচার কয়েক বছর ধরে আলোচিত। নতুন পথ বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া আর স্লোভেনিয়া হয়ে ইতালি।

ইউরোপের কূটনৈতিক একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, বছরখানেক ধরে ইতালি পাড়ি দিতে অন্যান্য দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি অনেক বাংলাদেশিও বসনিয়া ও স্লোভেনিয়া যাত্রা করছেন। বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়া বা স্লোভেনিয়া-ক্রোয়েশিয়া হয়ে উঠেছে ইউরোপে মানব পাচারের অন্যতম রুট বা পথ।

বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রথম আলোকে জানায়, গত এপ্রিল থেকে বসনিয়ায় অভিবাসীদের জন্য অন্তত সাতটি শিবির পরিচালনা করে আসছিল আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। বসনিয়ার কর্তৃপক্ষ শিবিরগুলো উঠিয়ে দিয়েছে। ফলে দুই সপ্তাহ ধরে ওই সব শিবিরে থাকা লোকজন ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী বসনিয়ার বন-জঙ্গল ও পরিত্যক্ত ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে সড়কের ধারে ছাপরা তুলে অবস্থান নিয়েছেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স গতকাল ও আগের দিন বুধবার জানিয়েছে, ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী ভেলিকা ক্লাদুসা শহরের কাছের বনে আর পরিত্যক্ত কারখানায় বাংলাদেশিসহ অন্তত পাঁচ শ অভিবাসনপ্রত্যাশী রয়েছেন। রয়টার্স বলছে, সেখানে অবস্থানরত ব্যক্তিরা ইতালি পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে ক্রোয়েশিয়া যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া পাকিস্তান, মরক্কো ও আলজেরিয়ার নাগরিক রয়েছেন।

রয়টার্সের প্রকাশিত বিভিন্ন ছবিতে দেখা গেছে, হাড়কাঁপানো শীতে লোকজন আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। জঙ্গলের এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি করছেন, নামাজ পড়ছেন, পরিত্যক্ত কারখানায় রান্না করছেন। আবার সীমান্তবর্তী সড়ক ধরে ক্রোয়েশিয়ার পথে যাত্রা করেছেন সারি সারি লোক। প্রকাশিত ২৫টি ছবির সব কটিতেই বাংলাদেশিদের মুখ দেখা গেছে।

সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিক মোহাম্মদ আবুল রয়টার্সকে বলেন, তাঁদের থাকার কোনো ঘর নেই, পানি নেই, টয়লেট নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তিনি জানালেন, তাঁদের ৫০০ জনকে বিহাক ও ভেলিকা ক্লাদুসা শহরের শিবির থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তাঁদের জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

বসনিয়ার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তা আজুর স্লিভিচ রয়টার্সকে বলেন, সার্বিয়া থেকে রাবারের নৌকায় চড়ে দ্রিনা নদী পেরিয়ে অভিবাসীরা বসনিয়ায় পৌঁছান। অথচ নদীটি এতই খরস্রোতা আর উত্তাল যে যখন-তখন পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। ফলে নৌকাডুবিতে অনেকে মারা যান। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তে ভিড় দেখে বোঝা যায়, মরিয়া এই অভিবাসীদের কোনো কিছুই আটকে রাখতে পারে না।

বসনিয়ার আগে গত মঙ্গলবার অবৈধভাবে ইউরোপে যাত্রার সময় স্লোভেনিয়ায় বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের শতাধিক অভিবাসী আটকের কথা জানা যায়।

স্লোভেনিয়ার বার্তা সংস্থা টোটাল স্লোভেনিয়া নিউজ বা টিএসএনের খবর অনুযায়ী, দেশটির দক্ষিণ–পশ্চিমের ইলিরস্কা বিস্ত্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে গত রোববার মোট ১৪৪ জনকে আটক করা হয়েছে। আটক অভিবাসীদের অধিকাংশই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নাগরিক। টিএসএনের গত মঙ্গলবারের প্রতিবেদনে সেখানকার ওরমজ এলাকায় পুলিশ একটি ভ্যান থেকে ২২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে আটক করে। তাঁদের মধ্যে ১১ ছিলেন বাংলাদেশের নাগরিক। পুলিশের সন্দেহ, আটক লোকজন ক্রোয়েশিয়া থেকে সম্প্রতি স্লোভেনিয়ায় পৌঁছান।

এএফপির এক খবরে বলা হয়, ক্রোয়েশিয়ার দক্ষিণ সীমান্তবর্তী ইলিরস্কা বিস্ত্রিকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গত রোববার ১১৩ জন অবৈধ অভিবাসীকে আটক করা হয়। শহরের মেয়র ইমিল রোচ গণমাধ্যমকে জানান, গত কয়েক সপ্তাহে অবৈধ অভিবাসী আটকের সংখ্যা বাড়ছে। এ বছরের প্রথম আট মাসে স্লোভেনিয়ায় অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপরাধে ১০ হাজার ২২৩ জন অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে।

বসনিয়ায় বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশ দূতাবাস দেশটির সঙ্গে কূটনীতিক যোগাযোগ রাখে। বসনিয়ার জঙ্গলে বাংলাদেশি অভিবাসীদের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ গতকাল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য দেশের অভিবাসীদের সঙ্গে ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তের কাছে বসনিয়ার জঙ্গলে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সম্পর্কে জানাতে বসনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছি। বসনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে আমাদের বিস্তারিত জানানোর আশ্বাস দিয়েছে। এ ছাড়া বসনিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের অনারারি কনসাল হারুদিন সমুনকেও এ বিষয়ে খোঁজ নিতে বলা হয়েছে।’

মানব পাচারের নানা পথ ও মৃত্যু

মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার ঘটনা অনেক দিন ধরে চলছে। বছর ১৫ আগে ঢাকা থেকে আকাশপথে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নিয়ে যেত পাচারকারীরা। সেখান থেকে সাহারা মরুভূমি পাড়ি দিয়ে নেওয়া হতো ভূমধ্যসাগর উপকূলে। এরপর রাবারের ছোট নৌকায় সমুদ্রযাত্রা। তখন সাহারা মরুভূমিতে অনেক বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর পাওয়া যেত। পরবর্তী সময়ে মানব পাচারের নতুন পথ চালু হয় লিবিয়া হয়ে। বিশেষ করে সামরিক শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর দেশটিতে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে এটি মানব পাচারের বড় পথ হয়ে উঠে। ২০১৫ সাল থেকে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করে।

প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে মানব পাচার বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মালয়েশিয়ায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর বিষয়টি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তখন খবর বের হয়, এসব অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের জঙ্গলে পাচারকারী চক্রের ক্যাম্পে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হতো। যাঁরা টাকা দিতে ব্যর্থ হতেন, তাঁদের পিটিয়ে হত্যা করে গণকবরে পুঁতে ফেলা হতো।

কেবল ইউরোপ বা মালয়েশিয়া নয়, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া হয়ে সাগরপথে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও মানব পাচারের একাধিক পথ রয়েছে। যদিও কয়েক বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সরকার তাদের সমুদ্রসীমায় পাহারা জোরদার করায় এই পথে এখন সুবিধা করতে পারছে না পাচার কারীরা।

এ ছাড়া কলম্বিয়া ও মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের অনেকে মারা গেছেন। অনেকে আটকও হয়েছেন। বিষয়টি কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচারবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনেও এসেছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর এবং স্থলসীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছানো ব্যক্তিদের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকা করেছে। ওই তালিকার চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের প্রথম আট মাসে বাংলাদেশের ৩ হাজার ৩২৫ জন নাগরিক ভূমধ্যসাগর আর স্থলপথে ইউরোপে পৌঁছেছেন। এ ছাড়া ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মারা গেছেন যথাক্রমে ৩৭৭১, ৫০৯৬, ৩১৩৯, ২২৭৭ ও ১৩১৯ জন।

সর্বশেষ গত মে মাসে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যাওয়ার আগে মরুভূমিতে পাচারকারীদের গুলিতে প্রাণ হারান ২৬ বাংলাদেশি। এরপরও পাচারকারীদের প্রলোভন থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বিরত করা যাচ্ছে না। চক্রগুলো পাচারের জন্য খুলছে নতুন নতুন পথ।

অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, লিবিয়া হয়ে মানব পাচারের ঘটনার বিষয়গুলো সামনে আসায় সম্প্রতি এ দেশে কিছু দালালকে ধরা হয়েছে। কিন্তু এ দেশে চক্রগুলোর মূল হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যতক্ষণ এদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা বন্ধ হবে না।