বাবাকে আর খুঁজবেন না ওহিদুর

সালেহা বেগমের স্বামী তিন বছর ধরে নিখোঁজ। ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছিলেন তিনি। সেই ছেলেও চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। এখন কাঁদার মতো শক্তিও আর যেন অবশিষ্ট নেই তাঁর। শাহবাগে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে গতকাল মারা যান ছেলে ওহিদুর ষ ছবি: প্রথম আলো
সালেহা বেগমের স্বামী তিন বছর ধরে নিখোঁজ। ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছিলেন তিনি। সেই ছেলেও চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। এখন কাঁদার মতো শক্তিও আর যেন অবশিষ্ট নেই তাঁর। শাহবাগে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে গতকাল মারা যান ছেলে ওহিদুর ষ ছবি: প্রথম আলো

...বাবার লাশটা পাইলেও তো একটা কবর হইত। আমি তো অভাগা, বাবার কবরটা জিয়ারতও করতে পারব না। ওদের বলেন, আমারে খালি বাবার কবরটা করার সুযোগ দেবে। আমি সব মেনে নেব।’
তিন বছর ধরে নিখোঁজ বাবাকে খুঁজে ফেরা ঢাকা কলেজের ছাত্র ওহিদুর রহমানের শেষ ইচ্ছাটি ছিল এমন। কিন্তু বাবাকে আর খোঁজা হলো না তাঁর। নাশকতার রাজনীতির কাছে হেরে গেছেন তিনি। গতকাল বুধবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা গেছেন ওহিদুর।
এ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার শাহবাগে বাসে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ ১৯ জনের মধ্যে তিনজন মারা গেলেন।
বয়স খুব বেশি হলে ২০ বছর হবে। তিন বছর ধরে নিখোঁজ বাবা গণপূর্ত অধিদপ্তরের জরিপকারক হাজি ওয়াজিউল্লাহ (৮০)। বাবার খোঁজে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেটিকে ছুটতে হয়েছে পুলিশের বিভিন্ন দপ্তরে, গণমাধ্যমের কার্যালয়ে।
স্বজনেরা জানিয়েছেন, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের অবিরামপুর গ্রামে ওহিদুরের লাশ দাফন করা হবে। যদি কখনো তাঁর বাবার লাশ (ধরেই নিয়েছেন জীবিত নেই) পাওয়া যায়, তবে ওহিদুরের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার আগামসিহ লেনের বাসা থেকে বের হয়ে বাসে শাহবাগে যাওয়ার পথে পেট্রলবোমার শিকার হন তিনি। ওহিদুরের শরীরের ২৮ ভাগ পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্বাসনালি। অবস্থার অবনতি হলে গত শনিবার তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। অবস্থা আরও খারাপ হলে গত সোমবার কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় তাঁকে। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গতকাল ভোর সাড়ে চারটার দিকে মারা যান তিনি।

গতকাল ভোরে বার্ন ইউনিটে পা রাখতেই শোনা গেল কান্নার শব্দ। মা সালেহা বেগমের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। অবাক বিস্ময়ে হাত নেড়ে বলছেন, ‘বাবু তো আমারে ছাইড়া কোথাও যায় না, আজ তুমি আমারে ছাইড়া যাইতে পারলা।’ একই সঙ্গে দেশের প্রচলিত রাজনীতি আর নেতা-নেত্রীদের ‘সমূলে বিনাশ’-এর অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন এই মা। বারে বারে উপস্থিত স্বজন আর গণমাধ্যমকর্মীদের বলছিলেন, ‘তোমরা ওগোরে কিছু করো, নাইলে আরো মায়ের কোল খালি অইবো।’

ওহিদুরের ভাই মজিবর রহমান বারে বারে চোখ মুছছিলেন। এর মধ্যেই অন্য স্বজনদের খবর দেওয়া, পুলিশকে জানানো—সব কাজ করতে হচ্ছিল তাঁকে। বিলাপ করছিলেন ভাবি সানু আক্তার আর ভগ্নিপতি সোয়ায়েব হোসেন।

দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে ওহিদুর ছিলেন সবার ছোট। রাজু ছিল ডাক নাম। কিন্তু সবার ছোট বলেই বাবু ডাকতে ডাকতে বাবুই হয়ে গেল ডাক নাম।

গাড়ি পেতেও ভোগান্তি: আইনি আনুষ্ঠানিকতা, ময়নাতদন্ত শেষে ওহিদুরের লাশ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি-অ্যাম্বুলেন্স কিছুই পাচ্ছিলেন না স্বজনেরা। সকালে দুটি অ্যাম্বুলেন্স যেতে রাজি হলেও ভাড়া দাবি করে ৮০ হাজার টাকা। বিপাকে পড়ে স্বজনেরা গণমাধ্যমকর্মীদের দ্বারস্থ হন। একজন সংবাদকর্মী আল মারকাজুলে ফোন করলে সেখান থেকে জানানো হয় নোয়াখালীতে তাঁদের দুটি অ্যাম্বুলেন্স অবরোধকারীরা ভেঙে দিয়েছেন। তাঁরা গাড়ি দেবেন না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুটি অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করেন স্বজনেরাই।

দুপুর একটার দিকে ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে লাশ নোয়াখালীর দিকে রওনা হয়। জানাজায় ঢাকা কলেজের ছাত্র, স্বজন, সংবাদকর্মী ও চিকিৎসাকর্মীরা অংশ নেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে অবিরামপুর গ্রামে জানাজা শেষে ওহিদুরের মরদেহ দাফন করা হয়।