বাবার স্মরণে রোগীদের জন্য কানিজের বিনা মূল্যে স্যুপ
গত ২৪ জুলাই বাবাকে হারিয়েছেন কানিজ ফাতেমা রুমা। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর কাছেই ছিলেন বাবা। শেষ দিকে বাবা যখন কিছুই খেতে পারছিলেন না, তখন তাঁকে কানিজ নিজ হাতে স্যুপ, খিচুড়ি, দুধ–সাগু—এসব নরম খাবার রান্না করে খাইয়েছেন। বাবাকে হারানোর বিষয়টি কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। নিজেকে নানাভাবে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছিলেন। একদিন কানিজের চোখে পড়ে ফেসবুকের একটি পোস্টে। করোনায় আক্রান্ত শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য ঘরে তৈরি স্যুপ কোথায় পাওয়া যাবে জানতে চাচ্ছেন একজন। কানিজ নিজে থেকেই পোস্টদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনা পয়সায় খাবার পৌঁছে দেন।
ফেসবুকের পোস্টদাতা ওই নারী নিজে ও তাঁর স্বামী—দুজনই চিকিৎসক। তাঁরা হাসপাতালে ডিউটির পাশাপাশি ঘরের রোগীদের দেখভাল করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তাই তাঁরা ঘরে রান্না করা স্যুপ খুঁজছিলেন। ওই চিকিৎসক দম্পতি কানিজকে টাকা দিতে চাইলেও তিনি নেননি। কানিজের মনে হয়েছে, বিনা মূল্যে স্যুপ খাইয়ে তিনি তাঁর বাবাকেই স্মরণ করছেন। মন খারাপের মধ্যেও কিছুটা শান্তি পাচ্ছিলেন। সেই শুরু।
‘কারও যদি কোনো অসুস্থ মানুষের জন্য স্যুপের দরকার হয়, প্লিজ, আমাকে নক দেবেন। শুধু নিজ দায়িত্বে নিয়ে যাবেন বা ডেলিভারি চার্জটুকু শুধু দিয়ে দেবেন। স্যুপের দাম নেওয়া হবে না। ’
ফেসবুক পেজে এই স্ট্যাটাসের সঙ্গে একটি ছবি যুক্ত করে পোস্ট করেছেন কানিজ ফাতেমা রুমা। কম বয়সী এক নারীর হাত বৃদ্ধ এক ব্যক্তির হাত ধরে আছে—এই হাত দুটি বাবা-মেয়ের হাত। দুটি পরিবারকে বিনা মূল্যে খাবার দেওয়ার পর কানিজ ফেসবুকে এ পোস্ট দেন।
‘কারও যদি কোনো অসুস্থ মানুষের জন্য স্যুপের দরকার হয়, প্লিজ, আমাকে নক দেবেন। শুধু নিজ দায়িত্বে নিয়ে যাবেন বা ডেলিভারি চার্জটুকু শুধু দিয়ে দেবেন। স্যুপের দাম নেওয়া হবে না। ’
এই পোস্ট দেওয়ার পর অনেকেই কানিজকে ফোন করে বা ফেসবুক পেজে এই উদ্যোগের জন্য সাধুবাদ জানিয়েছেন। খাবার নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত প্রতিদিনই তিনি হাসপাতালে ও বাসায় ১৭ থেকে ২০ জনকে খাবার সরবরাহ করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী কানিজ আড়াই বছর ধরে উদ্যোক্তা হিসেবে ‘রুমা’স কিচেন’নামে ফেসবুকে খাবারের পেজ চালাচ্ছেন। তিনি মূলত কেক, ডেজার্ট ও স্ন্যাকস তৈরি করে থাকেন। তবে অসুস্থ বাবাকে যত্ন করতে গিয়ে দেখেছেন, রোগীদের কষ্ট কতটা হয়। এ ছাড়া তাঁর স্বামীকেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। কানিজকে একাই তখন বাসা-হাসপাতাল করতে হয়েছে।
হাসপাতালের খাবার খেতে না পারায় তিনি স্বামীর জন্য বাসা থেকে পুষ্টিকর খাবার বানিয়ে নিয়ে গেছেন। সবকিছু মিলিয়ে তিনি নিজের ভেতরে একধরনের তাগিদ অনুভব করেছেন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হাসপাতালের মুমূর্ষু রোগীদের জন্য কিছু করার।
কানিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমে বুঝতে পারিনি, এত মানুষের কাছ থেকে সাড়া পাব। এখন আনন্দের সঙ্গেই কাজটি করে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় কেনাকাটা স্বামী করে দেন। আমাদের ছেলেটা প্যাকিংয়ে সহায়তা করে। দুই বেলা খাবার দিচ্ছি। বেলা একটায় ও বিকেল পাঁচটায়। খুব জরুরি হলে এই সময়ের বাইরেও খাবার পাঠিয়ে দিই। কেউ এসে বাসা থেকেও নিয়ে যান।’
নিজের খরচে কত দিন এই সেবা চালিয়ে যেতে পারবেন, জানতে চাইলে কানিজ বলেন, ‘বাবার চেহলাম (মৃত্যুর পর ৪০ দিন) পর্যন্ত এই সেবা সবাইকে দিয়ে যাব। এরপর শুধু হাসপাতালে ভর্তি মুমূর্ষু রোগীদের জন্য বিনা পয়সায় এই সেবা দেব। আর অন্যরা চাইলে কিনে নিতে পারবেন। সেই অর্থটাই আমি রোগীদের জন্য ব্যয় করতে পারব। হাসপাতালে ভর্তি মুমূর্ষু রোগীদের জন্য এই সেবাটা আমি আজীবন দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।’
স্ত্রীর এই উদ্যোগে পাশে থেকে সহায়তা করছেন কানিজের ব্যাংকার স্বামী এবং বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া একমাত্র ছেলে। স্ত্রীর এই কাজকে কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে খালিকুজ্জামান চৌধুরী বলেন, স্ত্রীর এই কাজে তিনি গর্বিত। অসম্ভব ভালো একটা কাজ। কানিজ তাঁর বাবাকে অনেক সেবা করেছেন। এখন সব অসুস্থ বাবা-মায়ের জন্যও তাঁর এ ভালোবাসা।
এই কাজ যাদের সহায়তা ছাড়া সম্ভব হতো না, সেই ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান অর্ডার বিডির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন কানিজ। এ প্রতিষ্ঠান দুজন ডেলিভারিম্যানকে তাঁর কাজের জন্য দিয়েছেন, কানিজ যখন যেখানে পাঠাতে চেয়েছেন এই দুজন কখনোই না করেননি। এমনকি ডেলিভারি চার্জও তিনি যা লিখে দেন, তা–ই নেন। ডেলিভারিম্যানরা তাঁকে বলেছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের মালিক কোনো ডেলিভারি চার্জ না দিলেও যাতে রোগীদের খাবার পৌঁছে দেন, সেই কথা বলে দিয়েছেন।
বুয়েটের শিক্ষার্থী ২৩ বছর বয়সী নূর হোসেন কয়েক দিন আগে করোনায় মাকে হারিয়েছেন। এখন তাঁর বড় ভাই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। নূর হোসেন নিজেও করোনার ধকল মাত্র কাটিয়ে উঠেছেন। তাঁদের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। এখন বড় ভাই ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। তাই তিনিও সেখানেই।
কানিজের এখন একটাই চাওয়া—তাঁর মতো অন্য যাঁরা রান্না পেশার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা সবাই যদি নিজ নিজ এলাকায় এগিয়ে আসেন, তাহলে আরও বেশি মানুষ এই ধরনের সেবা পাবেন। এতে ডেলিভারি চার্জও অনেক কমে আসবে।
নূর হোসেন জানালেন, তিনি সম্প্রতি রুমার রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়েছেন। বাসার রান্না খাবার বলেই এখান থেকে নিয়েছেন। তাঁর বোনের বাসা ঢাকায় হলেও সেখানেও অনেকে করোনায় আক্রান্ত। তাই তিনি মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকে কানিজের বাসায় গিয়ে ভাইয়ের জন্য স্যুপ, জাউ খিচুড়ি ও দুধ-সাগু নিয়ে আসেন। এ কাজের জন্য মুগ্ধ নূর হোসেন। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি।
আরেকজন গ্রাহক জান্নাত করোনায় আক্রান্ত তাঁর ছোট বোনের জন্য রুমার রান্নাঘর থেকে স্যুপ নিয়েছেন। ওই বোনই ফেসবুকের পোস্ট দেখতে পেয়ে খেতে চেয়েছিল। তাই জান্নাত সেখান থেকে অর্ডার করেন। জান্নাতও কানিজের ব্যবহারে মুগ্ধ। জানালেন, খাবারও বেশ ভালো ছিল।
কানিজের এখন একটাই চাওয়া—তাঁর মতো অন্য যাঁরা রান্না পেশার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা সবাই যদি নিজ নিজ এলাকায় এগিয়ে আসেন, তাহলে আরও বেশি মানুষ এই ধরনের সেবা পাবেন। এতে ডেলিভারি চার্জও অনেক কমে আসবে।