বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোয় ‘হত্যাচেষ্টা’, বাবা-মাও পাশে নেই মেয়েটির

সাঁওতাল সমাজে স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোকে দেখা হয় ‘গুরুতর অপরাধ’ হিসেবে। এ জন্য নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মহাবিপদে পড়েছেন সুমি মুর্মু (৩০)। সমাজের লোকজন তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি নিজের বাবা-মাও তাঁর পক্ষে নেই। এ সুযোগে সুমির বাবার বাড়িতেই এসে থাকছেন সাবেক স্বামী। সুমিকে তিনি দুই দফা হত্যার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ।

সর্বশেষ গতকাল সোমবার রাতে পুলিশ সুমিকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। এর আগেও জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাঁকে বাঁচিয়েছিল। সেবার পুলিশ তাঁর স্বামীকে সতর্ক করে এসেছিল। গতকাল রাতে সুমি মুর্মু রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া থানায় তাঁকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেছেন। ওই রাতেই তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

সুমির অভিযোগ, ১৪ বছর আগে যেদিন তাঁর বিয়ে হয়েছিল, সেই প্রথম দিনই শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাঁকে স্বামীর হাতে মার খেতে হয়েছিল। অব্যাহত নির্যাতনের কারণে তিনি ৮ জুলাই স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান। সুমি জানান, তাঁরা জাতি হিসেবে সাঁওতাল। আর খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী। সাঁওতাল সমাজে স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোকে দেখা হয় ‘গুরুতর অপরাধ’ হিসেবে। তাই সমাজের কাউকে তিনি পাশে পাচ্ছেন না। আর তাঁর স্বামী মুকুল টুডুর অনেক টাকা। তাই মুকুলের পক্ষে তাঁর (সুমির) বাবা-মাও। তাই তাঁদের বাড়িতেই মুকুলকে থাকতে দেওয়া হচ্ছে। ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে সুমি থাকেন বাড়ির দোতলায়। আর বাড়ির নিচতলায় থাকেন মুকুল।

সুমির বাবার বাড়ি রাজশাহী মহানগরের কয়েরদাড়া খ্রিষ্টানপাড়া মহল্লায়। তাঁর বাবার নাম আলবেট মুর্মু। সুমির সাবেক স্বামী মুকুল টুডুর বাড়ি নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার পাটিচোরা গ্রামে। মুকুল রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় খাদ্যগুদামের পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত।

সাবেক স্বামী মুকুল টুডুর অনেক টাকা। তাই সমাজপতিরা সবাই তাঁর পকেটে। এমনকি বাবা-মাও চাইছেন, মুকুলের সঙ্গে সংসার করতে।
সুমি মুর্মু, নির্যাতনের শিকার নারী

২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই সুমির বিয়ে হয় মুকুলের সঙ্গে। সুমি বলছেন, বিয়ের পর কথায় কথায় তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলে। এতে তিনি বুঝতে পারেন, তাঁকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন। এরই মধ্যে তাঁর দুটি সন্তান হয়। সব বাধা পেরিয়ে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস করেন। বর্তমানে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

সুমি বলেন, সাবেক স্বামী মুকুল টুডুর অনেক টাকা। তাই সমাজপতিরা সবাই তাঁর পকেটে। এমনকি তাঁর বাবা-মাও চাইছেন, তিনি যেন মুকুলের সঙ্গে সংসার করেন। কিন্তু সুমির আশঙ্কা, সুযোগ পেলেই মুকুল তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলবেন। এর আগে ১১ জুলাই সুমিকে হত্যার চেষ্টা করেন মুকুল। তখন তিনি ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেন। তখন সমাজপতিরা প্রথমে পুলিশকে তাঁদের পাড়ায় ঢুকতেই দেননি। পরে পুলিশ বাইরের ফটক ভেঙে পাড়ায় ঢুকে সুমিকে উদ্ধার করে।

ওই সময়ে পুলিশ মুকুল টুডুকে সতর্ক করে দেয় এবং সুমিদের বাড়িতে তাঁকে আসতে বারণ করে যায়। গতকাল রাতে সুমি রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। সেখানে যান মুকুল টুডু। সুমিকে তালাকনামা প্রত্যাহার করতে বলেন। তাতে রাজি না হলে সুমিকে পেটাতে শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁর গলা টিপে ধরেন। কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করে সুমি নিজের ঘরে গিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দেন। সেখান থেকেই তিনি পুলিশকে ফোন করেন। এরপর পুলিশ গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে।

অবশ্য পুলিশ পৌঁছানোর আগে সুমির ঘরের দরজা ভাঙার চেষ্টা করেন মুকুল। রাতেই পুলিশ সুমিকে থানায় নিয়ে আসে। কিন্তু সুমি যাতে মামলা করতে না পারেন, সে জন্য থানায় চলে আসেন সুমির সাবেক স্বামী, মা-বাবা ও সমাজপতিরা। তবে নির্যাতনের চিত্র দেখে পুলিশ মামলা নিয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তেজিত হয়ে পড়েন সুমির সাবেক স্বামী মুকুল টুডু। বলেন, ‘আমাদের পাড়ায় এসে মানুষের কাছ থেকে জানেন, কী ঘটনা ঘটেছে।’

তবে সুমি মুর্মুর মা পেরেন্তিনা হেমব্রম জামাইয়ের পক্ষে সাফাই গাইছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে তালাক দেওয়ার নিয়ম নেই। আর আমার জামাই মুকুল ভালো। আমার মেয়েই ভালো না। আমার জামাইয়ের পৃথিবীতে কেউ নেই। এতিম। এ জন্যই বাড়িতে রেখে দিয়েছি।’ সুমিকে মারধরের অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, সুমিকে মুকুল বোঝাতে গিয়েছিল। উল্টো সুমিই তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।

মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সুমির সাবেক স্বামী মুকুল টুডু। ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি সুমি মুর্মুর নামে উল্টো নানা অভিযোগ করতে থাকেন। একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন মুকুল। বলেন, ‘আমাদের পাড়ায় এসে মানুষের কাছ থেকে জানেন, কী ঘটনা ঘটেছে।’

মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিবারণ চন্দ্র বর্মণ। তিনি বলেন, সুমির সঙ্গে মুকুলের তালাক হয়ে গেছে। তারপরও কেন সুমিদের বাড়িতেই মুকুল আছেন? এটা তো হয় না। আবার তিনি সুমিকে মারধর করেছেন। এটা চলতে পারে না। পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে।