বৃষ্টি যেন ধানচাষিদের কান্না হয়ে ঝরছে
সাত বিঘা জমি বর্গা নিয়ে এ বছর বোরো ধানের চাষ করেছিলেন নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলা বুধুরিয়া গ্রামের কৃষক কার্তিক মুর্মু (৪৫)। সোনার ফসলের আশায় চার মাসের বেশি সময় ধরে রাতদিন কষ্ট করেছেন তিনি। যেখানে যা খরচ করার প্রয়োজন ছিল, কমতি রাখেননি। কিন্তু সে কষ্টের ফলাফল হতে যাচ্ছে প্রায় শূন্য। কারণ, শ্রমিকসংকটের কারণে এখনো ছয় বিঘা জমির ধান ঘরে তুলতে পারেননি কার্তিক। এদিকে খেতে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকা ধানে চারা গজাতে শুরু করেছে। দুই-তিন দিনের মধ্যে খেতের ধান কেটে ঘরে তুলতে না পারলে সব ধান নষ্ট হয়ে যাবে।
কার্তিক মুর্মু জানান, বোরো আবাদের জন্য তিনি সুদে স্থানীয় একটি এনজিওর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন। পরিকল্পনা ছিল কিছু ধান বিক্রি করে ঋণের টাকা শোধ করবেন। আর বাকি ধান দিয়ে সংসারের কয়েক মাসের খরচ জোগাবেন। কিন্তু ফসল ঘরে তোলার আগমুহূর্তে বৈরী আবহাওয়া আর শ্রমিকসংকটের কারণে তাঁর সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে যাচ্ছে।
কৃষক কার্তিক মুর্মু প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের দিনত থ্যাকে প্রতিদিনত বৃষ্টি হছে। খ্যাতত পানি জমে ধান লস্ট হয়ে যাছে। এদিকে প্যাটও (শ্রমিক) অমিল। ধান কাটার যে দু-একটা দল আছে. তারা বড় বড় গেরস্তের ধান কাটোছে। হামাগের মতো অল্প জমিওয়ালা কৃষাণের ধান কাটতে চাওছে না। বাধ্য হয়ে বউ-ছাওল লিয়ে খ্যাতের ধান ক্যাটতে শুরু করছি। বাকি ধান খ্যাততই পড়ে আছে। আর দুই-তিন দিন এভাবে বৃষ্টি হলে আর ধান ক্যাটতে না পারলে সব ধান খ্যাততই লস্ট হয়ে যাবে।’
কার্তিক মুর্মুর মতোই বোরো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ওই এলাকার কৃষক ফাগু পাহান, রাজীব সরদার, বিনোদ এক্কাসহ আরও অনেকেই। তাঁরা জানান, ঈদের আগেই ওই এলাকায় মাঠের প্রায় সব ধান পেকে যায়। কিন্তু কৃষকেরা ধান কাটার শ্রমিক না পাওয়ায় ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে খুবই ধীরগতিতে। ধান কাটা শ্রমিকের যে দু-একটি দল ধান কাটছে, তারা অনেক বেশি পারিশ্রমিক নিচ্ছে। গত বছর যে ধান কাটা-মাড়াইয়ে প্রতি বিঘায় দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছে, এবার সেখানে ছয়-সাত হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।
অন্যদিকে ধান কাটা শ্রমিকেরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়া, পানিতে ডুবে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং ঝড়ে খেতের ধান এলোমেলোভাবে নুয়ে পড়ায় এবার ধান কাটতে বেশি পরিশ্রম হচ্ছে। এ ছাড়া অধিকাংশ খেতের ধানই ভেজা অবস্থায় তোলা হচ্ছে। আবার পানিতে ডুবে অনেক ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এ জন্য এবার গতবারের তুলনায় তাঁরা পারিশ্রমিক বেশি নিচ্ছেন।
নওগাঁর সদর উপজেলার বর্ষাইল গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য জুলফিকার আলী এ বছর তাঁর নিজস্ব ১২ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। বেশ কিছুদিন আগেই মাঠের ধান পেকে গেলেও শ্রমিকসংকটের কারণে তাঁর ৮ বিঘা জমির ধান এখনো মাঠেই পড়ে আছে। এদিকে ঝড়ে নুয়ে পড়া ধানে চারা গজানো শুরু হয়েছে।
জুলফিকার আলীর সঙ্গে দেখা হয় গত বৃহস্পতিবার বিকেলে। ধান নিয়ে বিপাকে পড়া এই কৃষক হতাশার সঙ্গে বলেন, বাজারে ধানের দাম ভালো থাকলেও এবার ধান লাগিয়ে খুব একটা লাভ থাকছে না। পরিচর্যা ও সারের পেছনে এক বিঘা জমিতে প্রায় আট হাজার টাকা গেছে। ধান কাটা-মাড়াইয়ে খরচ হচ্ছে ৬-৭ হাজার টাকা। কিন্তু ধানের ফলন হচ্ছে মাত্র ১৮ থেকে ২০ মণ করে। এত খরচ করেও সেই ধান কাটার অভাবে ঘরে তুলতে পারছেন না। ঈদের দিন থেকে প্রতিদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। জমিতে পানি জমে ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আজ শুক্রবারও দিনভর নওগাঁয় থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। এতে মাঠে ধান পড়ে থাকায় কৃষকের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। নওগাঁর বদলগাছি আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে আরও দুই-তিন দিন এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হতে পারে।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) শামীম ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ধান চাষের জন্য নওগাঁ জেলার মাটি খুবই উপযোগী। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ অঞ্চলে প্রতি বিঘা জমিতে ২৪ থেকে ২৫ মণ করে ধানের ফলন হয়ে থাকে। তবে এবার বোরো ধান কাটার ভরা মৌসুমে ঘন ঘন ঝড়-বৃষ্টিতে এ অঞ্চলে বোরোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে ঝড়-বৃষ্টি, ব্লাস্ট রোগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করায় অনেক খেতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে খেতের ক্ষতি হয়েছে। এসব কারণে এবার ধানের উৎপাদন কিছুটা কম হতে পারে। বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটতে দেখা যাচ্ছে। গত বছর যেসব জমিতে ২৫ মণ ধান উৎপাদিত হয়েছে, এবার সেখানে ১৮-২০ মণ করে ধানের ফলন হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর ১ লাখ ৮৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগ জমিতেই চাষ হয়েছে জিরাশাইল ও কাটারিভোগ জাতের ধান। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলায় ৩৫ শতাংশ জমির ধান কাটা ও মাড়াই সম্পন্ন হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁর বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতি মণ শুকনা ধান ১ হাজার ১০০-১ হাজার ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভেজা ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০ থেকে ১ হাজার ৮০ টাকায়। এ ছাড়া বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের ধান প্রতি মণ ১ হাজার ১০ থেকে ১ হাজার ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।