জলাবদ্ধতা সমস্যার রাশ টানা এবং ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে বাড়ির ছাদে বৃষ্টির পানি ধরে তা ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সংশোধিত ‘ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, পরিবর্তন, সংরক্ষণ, অপসারণ) বিধিমালা-২০১৭’ এর খসড়ায় এ বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। বিধানটি কার্যকরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা রেখে ভবনের নকশা করতে হবে।
একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঠিক রাখতে বৃষ্টির পানি যাতে আবার মাটির নিচে চলে যেতে পারে, সে জন্য বাড়িতে কিছুটা খোলা জায়গা রাখার কথাও খসড়া বিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই তথ্য জানিয়ে বিধিমালা সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটির সদস্য মো. আশরাফুল ইসলাম আরও বলেন, আগের বিধিমালায় হেরিটেজ ভবনের আশপাশে কোনো স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে কী ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকবে, তার সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা ছিল না। সংশোধনীতে সেটাও স্পষ্ট করা হয়েছে।
সম্প্রতি জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে আয়োজিত এক আন্তবিভাগীয় সভায় গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনও ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখার বাধ্যবাধকতা তৈরির জন্য রাজউকের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন।
ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পদ্ধতি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং নামে পরিচিত। এতে ছাদে জমা বৃষ্টির পানি পাইপের মাধ্যমে চলে যাবে বিশেষভাবে তৈরি ভূতলের চেম্বারে। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুসারে এই পানি গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হবে।
বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, নির্মিতব্য প্রতিটি ভবনে এই পদ্ধতি কার্যকর করা গেলে বৃষ্টির পানি দিয়েই চাহিদার ১৫-২০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে নগরে বৃষ্টির পানি দ্রুত সরে যাওয়ার উপায় না থাকায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, তার প্রকোপও কমবে।
এ বিষয়ে কথা হয় রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) জিয়াউল হাসানের সঙ্গে। গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতিতে ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের বিধানটি সংশোধিত বিধিমালার খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নির্মিতব্য ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের এই ব্যবস্থা ভবন নির্মাণের অংশ হিসেবেই গণ্য হবে। তবে দুই কাঠার কম জায়গা থাকলে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না। আর পুরোনো ভবনের জন্য এটা বাধ্যতামূলক না হলেও কেউ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে আগ্রহী হলে তাঁর বাড়ির নকশা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নবায়ন করে দেওয়া হবে।
ঢাকা ওয়াসার হিসাবে, সংস্থাটির ৮০ শতাংশের বেশি পানির জোগান আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। এ বিষয়ে ওয়াটার এইড বাংলাদেশের এ দেশীয় পরিচালক খাইরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর ঢাকায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এতে এর মধ্যেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি যদি কেবল বাথরুমে ফ্ল্যাশ করা, গাড়ি ধোয়া কিংবা বাগান করার কাজে ব্যবহার করা যায়, তাহলেও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ অনেকখানি কমে যাবে, যা ভবিষ্যতের ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে বাধ্যবাধকতা তৈরির ক্ষেত্রে রাজউকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে খাইরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা চাইব যত দ্রুত সম্ভব এটি বাস্তবায়ন করা হোক। কারণ, কয়েক বছর ধরে বিষয়টি কেবল আলোচনার মধ্যেই আটকে আছে। আবার যেন আমাদের হতাশ হতে না হয়।’
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের একটি সমীক্ষা অনুসারে, শহরের সচ্ছল একটি পরিবারে সরবরাহ করা পানির ৪১ শতাংশ ব্যয় হয় গোসলের কাজে। আর ২২ শতাংশ কমোড ফ্ল্যাশ ও কাপড়চোপড় পরিষ্কারে। প্রতিবার ফ্ল্যাশে ১৫ লিটার পর্যন্ত পানি খরচ হয়। এ হিসাবে পাঁচ সদস্যের ওই পরিবারে কেবল টয়লেট ব্যবহারেই দৈনিক ৩৭৫ লিটার পানি খরচ হয়।
ঢাকার বাড়িগুলোতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়া গেলে এক বছরেই জলাবদ্ধতা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার সব কটি রাস্তার ওপর যে পরিমাণ বৃষ্টি পড়ে, তাতে জলাবদ্ধতার সমস্যা তৈরি হওয়ার কথা নয়। জলাবদ্ধতা তখনই হয়, যখন ভবনের ওপর পড়া বৃষ্টির পানি রাস্তায় নেমে আসে। তাই বৃষ্টির পানি যদি ভবনে আটকে রেখে ব্যবহার করা যায়, তাহলে তা আর রাস্তায় আসবে না।
মোবাশ্বের হোসেন আরও বলেন, আগে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে উঠান ছিল। বৃষ্টির পানি ছাদ থেকে গড়িয়ে উঠানে পড়ত। সেখান থেকে পানি কিছুটা রাস্তায় গড়িয়ে এলেও বেশির ভাগ ভূগর্ভে চলে যেত। এখন বাড়ি করার সময় ৩০-৪০ শতাংশ জায়গা ছাড়া হলেও সে জায়গাটা পাকা করে ফেলায় পানি আর মাটিতে যেতে পারে না। তাই খোলা জায়গা কেবল রাখলেই হবে না, তা উন্মুক্ত রাখতে হবে।