জেলেরা জাল গুছিয়ে বসে আছেন। ছবিটি ৩১ জুলাই ভোলার দৌলতখান থানার পাশের মাছঘাট থেকে তোলা l প্রথম আলো
জেলেরা জাল গুছিয়ে বসে আছেন। ছবিটি ৩১ জুলাই ভোলার দৌলতখান থানার পাশের মাছঘাট থেকে তোলা l প্রথম আলো

অন্য বছর এ সময় ভোলার বিভিন্ন নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত। জেলেদের জালে তড়পাত শত শত রুপালি ইলিশ। তা দেখে জেলেদের মুখে হাসি লেগেই থাকত। কিন্তু এবার ইলিশের আকাল চলছে। জেলেরা বিরস বদনে নদী থেকে জাল তুলছেন। অনেকের খরচই উঠছে না।

জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু থেকে কার্তিকের শেষ পর্যন্ত ইলিশ ধরার মৌসুম। এর মধ্যে আষাঢ়-শ্রাবণ ইলিশের ভরা মৌসুম। শ্রাবণ মাস যায় যায়। এখন জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ার কথা। কিন্তু তা পড়ছে না। তাই জেলেরা ভোলার মেঘনা, তেঁতুলিয়া, ইলিশা নদীতে জাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা থাকলেও অনেকেই তীরে বসে আছেন।

সদর উপজেলার তুলাতুলি ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর শ্রাবণ মাসে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকার ইলিশ উঠত। এ বছর প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ টাকার বেশি ইলিশ উঠছে না।

ভোলার সাগর মোহনার ঢালচর মৎস্যঘাটের আড়তদার শাহে আলম ফরাজি ও জেলে রবি আলম মাঝি বলেন, গত বছরের শ্রাবণ মাসে একজন ভাসান জালের জেলে সাড়ে তিন-চার লাখ টাকার ইলিশ পেতেন। কিন্তু এবার এক লাখ টাকারও পাচ্ছেন না।

ঘাটগুলোর তথ্যমতে, গত বছর ব্যাপক ইলিশ ধরা পড়ায় এ বছর ভোলার শতাধিক ঘাটে দুই হাজার নতুন মাছ ধরার নৌকা ও জাল নামানো হয়েছে। একটি নৌকা নামাতে ৫০ হাজার থেকে ২৫ লাখ টাকা খরচ হয়। তা ছাড়া প্রায় সব পুরোনো নৌকা সংস্কার করা হয়েছে। নতুন আড়তদারিতে নেমেছেন শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী। জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীরা চলতি বছর ভোলায় কমপক্ষে ১২০ কোটি টাকা নতুন লগ্নি করেছেন।

গত এক সপ্তাহ মাছঘাট ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভরা মৌসুমেও ঘাটগুলো এখনো জমে ওঠেনি। জেলে, আড়তদার, পাইকার ও দালালেরা অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছেন।

ভোলার দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া ইউনিয়নের বাঁধের পাড়ে থাকেন মো. সুলতান মাঝি (৪৪)। মেঘনা নদীতে মাছ ধরে সংসার চলে তাঁর। কিন্তু এই ভরা মৌসুমেও ইলিশের অভাবে তাঁর পাঁচ সদস্যের সংসারে চলছে টানাটানি। গত বুধবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খুব ভোরে ফজরের আজানের আগে কয়েকজন জেলে মিলে নদীতে জাল ফেলেন। জাল তোলার পর মাত্র দুটি ইলিশ পান। বিক্রি করে পেয়েছেন ৪৫০ টাকা। এ টাকা চার ভাগ হয়েছে। তেল-পান-তামাকের খরচও ওঠেনি।

ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের মো. নকিব (১৭) বলে, সে সাত দিন মাছ ধরতে যায় না। সংসারে সে ছাড়া আয়ের কেউ নেই, কিন্তু সংসারে পাঁচজন খানেওয়ালা। এ ছাড়া সপ্তাহে এক হাজার টাকা ঋণের কিস্তি শোধ করতে হচ্ছে। মাছ ধরতে না পারায় গত দুই সপ্তাহ সমিতির কিস্তি শোধ করতে পারেননি। খাওয়া চলছে মুদির দোকানে ঋণ করে।

একই গ্রামের জেলে আবুল হোসেন বয়াতি (৪০) বলেন, অনেক জেলে মেঘনা, তেঁতুলিয়া ও ইলিশা নদীতে জাল ফেলেও ইলিশ পাচ্ছেন না। ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে গেলে তাঁদের জ্বালানি তেল ও খাবারের খরচই ওঠে না। এ জন্য মাছ ধরতে না গিয়ে অনেকেই ঘাটে বসে আছেন।

জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গত বছরের জুলাইয়ে ইলিশ আহরণ করা হয় ১২ হাজার ১৮৫ মেট্রিক টন, এ বছর জুলাই মাসে এ পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৭৮২ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় গত বছরের জুলাই মাসে আহরণ হয়েছে ১ হাজার ১২৫ মেট্রিক টন ইলিশ, এ বছরের জুলাইয়ে ৮২৯ মেট্রিক টন আহরণ হয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, যেসব জাটকা নদীতে ছিল, সেগুলো বড় হয়ে সাগরে নেমে গেছে। নদীতে নৌকা অনেক বেড়ে গেছে। এসব কারণে হয়তো নদীতে এখন ইলিশ নেই। আশা করা যায়, ১৫ আগস্টের পর থেকে সাগরের ইলিশ ঝাঁকে ঝাঁকে নদীতে আসতে শুরু করবে। এরপরও যদি না আসে তবে ভাবতে হবে।