ভোগান্তির চরম রূপ

প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানাতে গতকাল বিকেল থেকে নগরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাস্তায় অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। দুর্বিষহ যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী। সন্ধ্যায় ফার্মগেট থেকে তোলা ছবি ষ প্রথম আলো
প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানাতে গতকাল বিকেল থেকে নগরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাস্তায় অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। দুর্বিষহ যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী। সন্ধ্যায় ফার্মগেট থেকে তোলা ছবি ষ প্রথম আলো

ভোগান্তির চরম রূপ দেখেছে ঢাকাবাসী। নিউইয়র্ক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরা উপলক্ষে দলীয় নেতা-কর্মীদের রাস্তায় অবস্থানের কারণে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে গতকাল সোমবার দুপুরের পর থেকেই ঢাকা স্থবির হয়ে পড়ে। বিকেলের পর রাজপথ কার্যত অচল হয়ে যায়। এ অবস্থা চলে রাত পর্যন্ত।বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাকির হোসেন উত্তরা থেকে দেশবাংলা পরিবহনে চেপেছিলেন বেলা তিনটায়। ফার্মগেট যখন পৌঁছান তখন সন্ধ্যা সাতটা। ১৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে লেগেছে চার ঘণ্টা। এর মধ্যে মহাখালী থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ জাকির পাড়ি দেন হেঁটে। জাকির জানান, উত্তরা থেকে বাস ছেড়ে বিমানবন্দরে এসেই আটকে যায়। হাজার হাজার মানুষ রাস্তা দখল করে আছে। সেখান থেকে হাঁটা গতিতে গাড়ি মহাখালী আসতে বেজে যায় বিকেল পাঁচটা। এরপর প্রায় দেড় ঘণ্টা মহাখালীতে আটকে থেকে হাঁটা শুরু করেন তিনি।একটি ছাপাখানার কর্মী মুহিবুল্লাহ পল্টন থেকে বিআরটিসির একটি দোতলা বাসে উঠেছিলেন বিকেল চারটায়। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার সময় বাসটি দাঁড়ানো কারওয়ান বাজারে। তিনি বলেন, পৌনে এক ঘণ্টা ধরে এক জায়গায় বাস দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঢাকা ওয়াসার কর্মীদের বহনকারী বিআরটিসির একতলা দুটি বাসও আটকে ছিল ফার্মগেটে। এই দুটি বাসই কারওয়ান বাজার থেকে বিকেল পাঁচটার দিকে যাত্রা করে।
পুরো ঢাকা কার্যত অচল: সরেজমিনে দেখা গেছে, সাউথ সাউথ পুরস্কার গ্রহণ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য দুপুরের পর থেকেই বিজয় সরণি থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন পর্যন্ত সড়ক আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দখলে চলে যায়। বিকেল চারটার পর তা জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় এবং সড়ক কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেন বিমানবন্দরের আশপাশেও ।

এর ফলে গাজীপুর, টঙ্গী, উত্তরা, আবদুল্লাহপুর থেকে আসা বাসগুলো বিমানবন্দরে আটকে যায়। আর যেসব যানবাহন বিমানবন্দর পার হতে পেরেছিল, সেগুলো মহাখালীতে আটকা পড়ে। অন্যদিকে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, গুলিস্তান, সদরঘাট থেকে আসা যানবাহন আটকা পড়ে ফার্মগেট-বিজয় সরণিতে। একইভাবে মিরপুর থেকে আসা যানবাহন বিজয় সরণিতে, আজিমপুর, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও গাবতলী থেকে আসা যানবাহন সংসদ ভবনের আশপাশে থমকে যায়।

প্রগতি সরণি হয়ে মালিবাগ এবং গাবতলী থেকে আজিমপুর—এই দুটি পথ বাদ দিলে বাকি সব পথের যানবাহন ফার্মগেট, বিজয় সরণি ও মহাখালী হয়ে চলাচল করে। গতকাল দুপুরের পর থেকেই মহাখালী, ফার্মগেট ও বিজয় সরণি স্থবির হয়ে পড়ে। বিকেল পাঁচটার পর তিনটি স্থানই বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে অন্য যেসব সড়কে প্রতিবন্ধকতা ছিল না, সেগুলোও অচল হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিড় ঠেলে বিজয় সরণি পার হয়ে গণভবনে প্রবেশ করলে সড়ক খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু এর রেশ চলতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত।

কতক্ষণ পা চলে?: ‘ভাই, আর পা চলছে না। এক হাঁটায় কত পথ চলা যায়। শরীর তো কুলাতে হবে।’ গত সন্ধ্যায় সংসদ ভবনের খেজুরবাগানের কোনায় টাইলস মিস্ত্রি আমির হোসেন যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছিল তাঁর। তিনি জানান, রমনা থানা ভবনে টাইলসের কাজ করেন তিনি। কাজ সেরে বাস ধরার জন্য বাংলামোটরের দিকে হাঁটা দেন। কিন্তু বাংলামোটর এসে দেখেন সারি সারি যানবাহন ইঞ্জিন বন্ধ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। আবার হাঁটা শুরু করেন তিনি। কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, খেজুরবাগান পার হয়ে গেলেও পেছনের বাস, গাড়ি সব আগের অবস্থানেই। একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েন। আমির হোসেনের সঙ্গে খেজুরবাগানের কাছে কথা হয় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। তখনো প্রধানমন্ত্রী বিজয় সরণি পার হননি। এরপর আমির যানবাহন পেয়েছিলেন, নাকি কাজীপাড়ায় হেঁটেই গেছেন, তা জানা যায়নি।

আমিরের মতো হাজার হাজার মানুষকে কাল হেঁটেই বাসায় পৌঁছাতে হয়েছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চালক জেমস লকরেকের সঙ্গে কথা হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে। তখন ঘড়িতে সময় সন্ধ্যা সাতটা। ফুটপাত ধরে প্রচুর মানুষকে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি চলে গেছে। কিন্তু যানবাহন আটকে আছে। জেমস বলেন, গলিপথ ধরে রিকশায় আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছু পথ এসে গলিপথেও যানজটে পড়েন। শেষমেশ হেঁটে যাচ্ছেন।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ফার্মগেট এসে দেখা গেছে ধীরে হলেও যানবাহন চলা শুরু করেছে। কিন্তু ভিড়ের কারণে উঠতে পারছেন না কেউ।

চারদিকে সড়ক আটকে থাকার কারণে ফার্মগেটের তেজগাঁও কলেজের সামনের সড়ক, সংসদ ভবনের খেজুরবাগান, সংসদ ভবনের পূর্ব পাশের সড়কে কোনো যানবাহন ছিল না সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাতটা পর্যন্ত। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সুরাইয়া বেগম ও রাহেলা খাতুন তেজগাঁও কলেজের সামনে রিকশা নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাঁরা বলেন, গ্রিন রোড থেকে হেঁটে ফার্মগেট এসে প্রায় দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন। যাবেন মিরপুর ১০ নম্বর। কিন্তু আর হাঁটার শক্তি নেই। রিকশায় কিছু পথ এগোনোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু রিকশাচালকেরাও রাজি হচ্ছেন না।

সপ্তাহের প্রথম দিন শুরু: ট্রাফিক পুলিশ ও ভুক্তভোগীরা জানান, ঢাকাবাসীর দুর্ভোগ শুরু হয়েছে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার থেকেই। গতকাল সোমবার তা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা মিরপুর রোড দখল করে রোববার গাড়ি ভাঙচুর শুরু করলে সারা দিনই ঢাকা প্রায় অচল ছিল। দলীয় নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া সংবর্ধনার ফলে দ্বিতীয় দিনটাও ঢাকাবাসীর জন্য দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আজ বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায় দেবেন। এ অবস্থায় আজ বা কাল কী প্রতিক্রিয়া হয়, সে দুশ্চিন্তাও আছে নগরবাসীর। আবার গত সপ্তাহে বেতন-ভাতার দাবিতে পোশাকশ্রমিকেরা কয়েকটি এলাকায় রাস্তায় নামলে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছিল নগরবাসীকে।