মজুত চাল নিয়ে বিপাকে সরকার

এখন বাজারে মোটা চালের কেজি ৩০ থেকে ৩২ টাকা। আর খাদ্য অধিদপ্তর খোলাবাজারে বিক্রি করছে ২০ টাকায়। কিন্তু এই চালের মান পড়ে যাওয়ায় সহজে বিক্রি হচ্ছে না। তাই ৩২ টাকা কেজি দরে কেনা এই চাল এখন ১৫ টাকায় বিক্রির পরিকল্পনা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে আমনের ৮৯ হাজার টন চাল সংগ্রহ বাকি আছে। আগামী মে থেকে ১০-১২ লাখ টন বোরো সংগ্রহ শুরু হবে। এ জন্য গুদাম খালি করতে হবে। কিন্তু সরকারের খাদ্য বিক্রির অন্যতম উপায় খোলাবাজারে চাল (ওএমএস) বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। সাতটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ করা খাদ্যের বণ্টন ও বিক্রিও চলছে শ্লথগতিতে।
গত ১৩ নভেম্বর খাদ্য অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুদামে থাকা চালের বড় অংশের মান ক্রমশ কমছে। ওই প্রতিবেদনে দ্রুত চাল খালাসের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো সরকারি গুদামে মান পড়ে যাওয়া এক লাখ পাঁচ হাজার টন চাল রয়ে গেছে।
গত বুধবার ত্রাণ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় সাংসদেরা টিআর ও কাবিখায় চাল-গম চান না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা সরকারের কাছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য নগদ অর্থ চেয়েছেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ কাজী শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের খাদ্য সংগ্রহের প্রধান লক্ষ্য থাকে সরকারি মজুত বাড়ানো এবং কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। এবার মজুত ভালোই বেড়েছে, কিন্তু সরকারি সংগ্রহ কর্মসূচি কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। বরং খাদ্য মজুত এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে গুদামে খাদ্য রাখলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। আর দ্রুত ছেড়ে দিলে বোরোর আগে ধানের দাম কমে গিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে এবারের খাদ্যবিষয়ক পরিকল্পনা সঠিকভাবে হয়নি।
গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে সার্বিক খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। এতে চাল মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই কীভাবে দ্রুত বিতরণ করা যায়, সে ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদসহ অর্থ, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় চালের দাম কমিয়ে গুদাম খালি করার ব্যাপারে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে যে প্রস্তাব তৈরি করেছে, তাতে চাল ১৫ থেকে ১৬ টাকা কেজি ও আটার খুচরা মূল্য ১৪-১৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের পাশাপাশি ইউনিয়ন ও মহানগরের ক্ষেত্রে ওয়ার্ডে ওএমএস কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মুশফেকা ইকফাৎ প্রথম আলোকে বলেন, আগামী মে থেকে বোরো সংগ্রহ শুরু হবে। কিন্তু বেশির ভাগ গুদামে বেশ ভালো পরিমাণে চালের মজুত আছে। বণ্টনব্যবস্থায় কিছু বদল এনে ওই চাল দ্রুত খালাস করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রতি টন চালের প্রকৃত মূল্য ৩৬ হাজার ৩৩৫ টাকা ৫০ পয়সা। চলমান ওএমএস কার্যক্রমে প্রতি টন চালে ১৮ হাজার ৫০০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে ১৭ হাজার ৮৩৫ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। ১৫ টাকা কেজি দরে ওএমএস চাল বিক্রি করতে গেলে প্রতি টনে ভর্তুকি দিতে হবে ২১ হাজার ৩৫৫ টাকা ৫০ পয়সা। এতে প্রতি মাসে সরকারকে ওই খাতে ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।
ওএমএসের জন্য ওই অতিরিক্ত ভর্তুকি কোথা থেকে আসবে—এ প্রশ্ন করলে খাদ্যসচিব মুশফেকা ইকফাৎ বলেন, এ জন্য সরকারকে খাদ্য বাবদ নতুন ভর্তুকি যাতে বাড়াতে না হয়, সেভাবেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেসব খাতে বিনা মূল্যে চাল-গম দেওয়া হতো, সেখানে কিছু শুভেচ্ছামূল্য নেওয়া যায় কি না, সে ব্যাপারে চিন্তা করা হচ্ছে।
আগেও দাম কমেছে, বিক্রি বাড়েনি: এর আগে গত ২৩ নভেম্বর সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন বিভাগ থেকে ‘দাম কমালে বিক্রি বাড়বে’ এই যুক্তিতে চাল ও গমের দাম এক দফা কমানো হয়েছিল। প্রতি কেজি ওএমএস চালের দর ২৪ টাকা থেকে কমিয়ে ২০ ও গমের দাম ১৯ টাকা করা হয়েছিল। কিন্তু এর পরে সাড়ে তিন লাখ টন ওএমএসের চালের মধ্যে মাত্র ৮১২ টন বিক্রি হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও খাদ্য নিয়ে গবেষণা করেন এমন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাজারমূল্যের চেয়ে ১০ থেকে ১২ টাকা কম দরে বাজারে ছাড়ার পরও সরকারি চাল বিক্রি হচ্ছে না। এখন দাম আরও কমালে যে বিক্রি হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। বরং বোরো ধান কাটার ঠিক আগে আগে অল্প দামের ওই চাল বাজারে ছাড়লে তা কালোবাজারি হবে। চালের দাম কমে গিয়ে ধানের দামও কমবে। এতে বোরো চাষিরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
গত ১৩ নভেম্বর খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফয়েজ আহমেদ খাদ্যসচিবের কাছে এক চিঠিতে জানান, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ৭৮ হাজার টন বোরো চাল এখনো রয়ে গেছে। ১২-১৩ মাস ধরে এসব চাল গুদামে আছে। চিঠিতে তিনি বলেন, সাধারণত বোরো চাল ১০ মাস ও আমন চালের মান ১২ মাস পর থেকে কমতে থাকে। এ জন্য এসব চাল দ্রুত খালাস করা প্রয়োজন।
ইতিমধ্যে এই চিঠি দেওয়ারও প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গেছে। ‘সরকারি খাদ্যশস্য পরিস্থিতির গত ৩১ জানুয়ারির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুদামে ২০১৩-১৪ সালে কেনা ২৩ হাজার ৪৫৪ টন বোরো ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কেনা ৮১ হাজার ২১০ টন আমন চাল অর্থাৎ সর্বমোট ১ লাখ ৪ হাজার ৬৬৪ টন পুরোনো চাল রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ কাজী শাহাবুদ্দিন এ ব্যাপারে আরও বলেন, সাধারণত খাদ্য মজুতের ঘাটতির কারণে সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে। এবার মজুতের চাল সঠিকভাবে বণ্টন না করায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিকল্পনা করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, না হলে কৃষির উন্নতি হবে, কিন্তু কৃষকের উন্নতি হবে না। আর সেই উন্নতি টেকসই হবে না।