মনে সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয়

লাঠিতে ভর দিয়ে কোনোরকমে হাঁটতে পারেন সাইফুল আলম। তবে শক্তি, সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনিছবি: প্রথম আলো

সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পা অচল হওয়া সাইফুল আলম এখন সফল উদ্যোক্তা ও কারখানার মালিক। তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন অন্তত ২০০ শ্রমিক। তাঁর কারখানায় তৈরি হচ্ছে দেশি কৃষি যন্ত্রপাতি, বিক্রি করছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। বর্তমানে তাঁর বার্ষিক আয় ৮০ লাখ থেকে কোটি টাকা।

বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো এই ব্যবসায়ীর নাম সাইফুল আলম (৪৩)। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস এলাকায়।

দুই হাতে দুটি লাঠিতে ভর দিয়ে কোনোরকমে হাঁটতে পারেন সাইফুল আলম। তবে তাঁর মনে প্রবল শক্তি, সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয়। সেই সাহসিকতার পথটা মসৃণ ছিল না। কুষ্টিয়া–ঝিনাইদহ মহাসড়কের পাশে বটতৈল এলাকায় কারখানাটির অবস্থান। নাম গ্লোবাল সলিউশন মেশিনারিং (জিএসএম) ইঞ্জিনিয়ারিং।

সাইফুলের বাবা আবদুল জলিল সরকার ছিলেন কুষ্টিয়া সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের করণিক, মা হাসিনা বানু গৃহিণী। ১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক পাস করার পর পলিটেকনিক থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেন সাইফুল। এরপর ১৯৯৭ সালে ঢাকাতেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে টেকনিশিয়ানের চাকরি শুরু করেন। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০০ সালের দিকে সিঙ্গাপুরে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। ২০০২ সালে তিনি আরেকটি প্রতিষ্ঠানে দেশীয় ব্যবস্থাপক পদে যোগ দেন। ২০০৪ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিএসসি ডিগ্রি নেন তিনি।

চাকরিতে উন্নতি আর দক্ষ প্রকৌশলী হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সাইফুল আলম। কিন্তু ২০০৬ সালে তাঁর জীবনে ঘটে যায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

সেই ঘটনা বলতে গিয়ে থমকে যান তিনি। ওই বছরের ৭ এপ্রিল পাবনা থেকে কুষ্টিয়া ফেরার পথে ঈশ্বরদীতে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। এতে তাঁর মেরুদণ্ডে আঘাত লাগে। উন্নত চিকিৎসা নিলেও দুটি পা একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন কুষ্টিয়ার নিজ এলাকায়।

দুই পা অচল হলেও মনোবল হারান না সাইফুল। বাড়িতে বসেই যোগাযোগ করতে থাকেন বিভিন্ন জায়গায়। নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখেন। চৌড়হাসের পাশেই বটতৈল এলাকায় কুষ্টিয়া–ঝিনাইদহ মহাসড়কের পাশে নিজের জমানো ও ধারদেনা করা টাকা দিয়ে ২২ কাঠা জমি কেনেন। তখন ২০১০ সাল। ছোট একটি টিনশেডের কারখানায় তিনি কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ শুরু করেন। বিদেশ থেকে আমদানি করেন অটো রাইস মিলের যন্ত্রাংশ।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সাইফুল আলমের। ২২ কাঠার জায়গায় সেখানে বর্তমানে সাত বিঘা জমিতে বিশাল কারখানা দাঁড়িয়েছে। এখন তিনি অটো রাইস মিলের যন্ত্রাংশের কারখানার মালিক। সেখানে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি। ধান কাটা, ধান মাড়াই-ছাঁটাই, ঘাস কাটা, বিচালি কাটা থেকে শুরু করে ভুট্টা ছড়ানোর যন্ত্রাংশ তৈরি করছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন অন্তত ২০০ শ্রমিক।

কারখানায় দীর্ঘদিন কাজ করা শ্রমিক ওয়ারেশ হোসেন বলেন, ‘স্যারকে কাছ থেকে দেখেছি। একটা শিশু যেমন অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না, স্যারও ঠিক তেমনি। তারপরও তিনি এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের বাহক।’

জিএসএমের কারখানায় তৈরি হওয়া অটো রাইস মিলের যন্ত্রাংশ ময়মনসিংহ, নাটোর, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। ভারত, চীনসহ কয়েকটি দেশ থেকে কিছু যন্ত্রাংশ আমদানি করেন। প্রতিদিন সাইফুল আলম কারখানায় গিয়ে শ্রমিকদের কাজ তদারকি করেন। তিনি বলেন, ‘আমদানি করা যন্ত্রপাতির তুলনায় কম টাকায় দেশি যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে। তবে এর মান বিদেশি যন্ত্রের মতোই। আমার কারখানায় উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অটো রাইস মিল তৈরি করা সম্ভব।’

সাইফুল আলম জানান, বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠানে ৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এ বিনিয়োগ ৫০০ কোটি টাকায় নিতে চান। এতে কারখানার প্রসার যেমন বাড়বে, তেমনি এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তাঁর স্বপ্ন দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষক ও কৃষি শিল্পে উন্নয়ন ঘটানো। পিছিয়ে পড়া মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এ জন্য তিনি তাঁর এই ক্ষুদ্র শিল্পে সরকারি সহায়তা কামনা করেন।

কুষ্টিয়া বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সোলাইমান হোসেন জানান, ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে সাইফুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত। তিনি কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনে এলাকার কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে বেশ ভূমিকা পালন করছেন। তাঁকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়। এবারের ঢাকায় এসএমই মেলাতে তাঁর প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রাংশ তুলে ধরা হবে।

সাইফুল আলম শুধু একজন সফল উদ্যোক্তাই নন, তিনি এলাকার প্রতিবন্ধীদের প্রেরণা। প্রতিবন্ধীদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়ানোর পাশাপাশি তিনি নিজেকে সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তিনি চৌড়হাস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি। কুষ্টিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে ২০১৭ সাল থেকে টানা তিনবার পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। পাশাপাশি তিনি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য। তাঁর স্ত্রী তানিয়া সুলতানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তাঁদের দুই ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ে।

কুষ্টিয়া চেম্বারের পরিচালক খাজানগর এলাকায় ফ্রেশ অ্যাগ্রো ফুড লিমিটেডের মালিক ওমর ফারুক জানান, সাইফুল অনেক সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। অনেক চ্যালেঞ্জিং পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাঁকে। তিনি ব্যবসায়ীদের প্রেরণার শক্তি।