মন খারাপের মেঘ সরিয়ে এল খুশির ঈদ

ফাইল ছবি

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’! পবিত্র রমজানের শেষ দিনে আমরা তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে, খুঁজতে থাকি চাঁদের রুপালি আভা। চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে মনপ্রাণ ভরে ওঠে। মন আপনাআপনি গেয়ে ওঠে: ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’! আর টেলিভিশনগুলোয় যখন ওই গানটা বাজতে থাকে, একটা খুশির হিল্লোল বইতে শুরু করে আকাশে-বাতাসে!

গত দুই বছর আমাদের ঈদগুলো এসেছে করোনার বৈশ্বিক মহামারির মন খারাপ করা মেঘের ছায়ায়। আমরা অনেকেই ঘরে নামাজ পড়তে বাধ্য হয়েছি। কারওবা বাড়িতে ছিল স্বজন হারানোর শোক। অনেকের ঘরেই ছিল কোভিড-রোগী নিয়ে উদ্বেগাকুল পরিস্থিতি। আমাদের বহু দোকানপাট ও ব্যবসা ঈদকেন্দ্রিক, সেসবের বিকিকিনিতে ছিল মন্দা। বহু মানুষের রুটিরুজির উপায়গুলো ছিল বন্ধ। একাধিকবার গণপরিবহনই বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। ২০২২-এর ঈদের চাঁদ উঠবে করোনার মেঘমুক্ত আকাশে; আমরা এবার রোজা আর ঈদ পালন করছি অনেকটাই বুকভরে শ্বাস নিয়ে। জানি, স্বজন হারানোর বেদনা উৎসবের দিনগুলোতেই করুণতর হয়ে বাজে। আমরা নিশ্চয়ই স্মরণ করব তাঁদের, যাঁদের হারিয়েছি বিগত সময়ে।

ফাইল ছবি

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’ গানের পরের লাইনগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ:

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।

তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ।

দে জাকাত, মুরদা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।

নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, জাকাত দেওয়ার ডাক নিয়ে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। জমানো উদ্বৃত্ত টাকা, সোনাদানা, সম্পদের ওপরে আড়াই ভাগ জাকাত যদি সম্পন্ন মুসলমানেরা ঠিকঠাকভাবে দান করেন, দেশে দারিদ্র্য থাকার কথা নয়।

২০২২-এর ঈদের চাঁদ উঠবে করোনার মেঘমুক্ত আকাশে; আমরা এবার রোজা আর ঈদ পালন করছি অনেকটাই বুকভরে শ্বাস নিয়ে। জানি, স্বজন হারানোর বেদনা উৎসবের দিনগুলোতেই করুণতর হয়ে বাজে। আমরা নিশ্চয়ই স্মরণ করব তাঁদের, যাঁদের হারিয়েছি বিগত সময়ে।

এই দেশের ঈদের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো উৎসে ফিরে যাওয়া। শহরে বাস করা মানুষ ফিরে যান তাঁদের জন্মভিটায়, সন্তানেরা ফেরে মায়ের কোলে; ভাইবোন-আত্মীয়স্বজন, পুরোনো সহপাঠী পাড়াপড়শির পুনর্মিলন ঘটায় ঈদ। একসঙ্গে এত মানুষ শহর ছাড়ে যে পরিবহনব্যবস্থার ওপরে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। এবার উত্তরবঙ্গগামী মানুষের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে, লঞ্চেও ভিড় কম। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী মানুষেরা সাগ্রহে তাকিয়ে আছেন পদ্মা সেতুর দিকে। আগামী বছরের ঈদুল ফিতরে নিশ্চয়ই ঘাটে ঘাটে ফেরির জন্য অনিশ্চিত অপেক্ষার কষ্ট আর করতে হবে না।

আমরা বহু ক্ষেত্রে ভালো করছি। শতভাগ বিদ্যুতের দেশ বাংলাদেশ—এই সাফল্য সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে। এখন দরকার সঞ্চালনব্যবস্থার উন্নতি। আশা করি, তা–ও হয়ে যাবে। বিদ্যুতের সুফল পড়ছে অর্থনীতিতেও; উৎপাদন বাড়ছে, গ্রামে-গঞ্জেও টিভি-ফ্রিজ-ফ্যান বিক্রি হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনার পর সারা বিশ্বে চাহিদা বৃদ্ধি এবং জাহাজজটের কারণে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দিয়েছিল রোজার আগে আগে; এক কোটি পরিবারকে সুলভ মূল্যে পন্য কিনতে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় এনে সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। করোনার টিকাদানে বাংলাদেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে সরকারের প্রশংসা করতেই হবে। সরকারের গৃহায়ণ প্রকল্প এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পে লাখো পরিবার পেয়েছে ঠিকানা, কয়েকটা নেতিবাচক খবরের আড়ালে এই প্রকল্পের সুফলভোগীদের মুখের হাসি আড়াল হয়ে যাবে না নিশ্চয়ই। সংবাদমাধ্যমের কাজ ভুলত্রুটি-অনিয়ম তুলে ধরা, সরকারের কাজ ভালো কাজ করে যাওয়া।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, সক্রিয় এবং সোচ্চার নাগরিক সমাজ আসলে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, গণতন্ত্রকে কার্যকর করার হাতিয়ার। সংবাদমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের কণ্ঠরোধ করার আত্মঘাতী প্রয়াস কাম্য নয়। নিউমার্কেট এলাকার সাম্প্রতিক সংঘর্ষে দুঃখজনক প্রাণহানি ও জানমালের ক্ষতির পর আমরা দেখলাম, দেরিতে হলেও অস্ত্রধারীদের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কলাবাগানের তেঁতুলতলা খেলার মাঠে থানা নির্মাণের উদ্যোগের প্রতিবাদ হয়েছে একেবারে স্থানীয়ভাবে, এটা নাগরিকশক্তির সাফল্যের একটা ছোট্ট কিন্তু অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদ, একজন মা ও কিশোরকে আটকে রাখায় ক্ষোভ, নাগরিক সমাজের প্রতিবাদী ভূমিকা, পেশাদার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিক্রিয়ায় কাজ হয়েছে। পরে প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন খেলার মাঠে থানা স্থাপন না করতে। এই দুটি ঘটনা যেমন দুঃখজনক, তেমনি তা আমাদের মেঘের আড়ালে সূর্যের রুপালি রেখাটুকুও দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের আশা আছে, বাংলাদেশে আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে।

বাংলাদেশে ঈদ যেমন ধর্মীয় উৎসব, তেমনি এটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবও। এই উৎসব সর্বজনীন। উৎসব মানেই মিলন। ঈদ আমাদের মিলিত করুক। আমরা যেন সম্প্রীতির সূত্রগুলো অনুসন্ধান করি, বিভেদের দাগগুলো মুছে ফেলি। কাজী নজরুলের ভাষায়: ‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে’। আমাদের আরও পরমতসহিষ্ণু হতে হবে, আমাদের আরও গণতান্ত্রিক হতে হবে। গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধগুলোকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে হবে। এই চাওয়া যেমন সরকারের কাছে, এই চর্চা তেমনি করতে হবে সমাজজীবনের সবখানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা কী প্রকাশ করি, কী প্রতিক্রিয়া জানাই, সেটাতেও কিন্তু বোঝা যায়, আমাদের নাগরিকেরা কতটা গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে ধারণ করেন! নিজের পরিবারের মধ্যে যদি পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা থাকে; যদি নারীকে সম্মান জানানোর রেওয়াজ থাকে; যদি ধর্মকে ভেদের নয়, মিলনের চেতনায় ধারণ করা যায়; তাহলে রাষ্ট্রীয় জীবনেও তার প্রতিফলন দেখা দেবে। আবার রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয়, উদার হয়, অসাম্প্রদায়িক হয়, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, সংখ্যালঘুদের প্রতি মর্যাদাশীল হয়; সমাজেও তার প্রভাব পড়বে।

করোনার ছায়ামুক্ত পরিবেশে এবারের ঈদ সবার জন্য হোক নিরাপদ, আনন্দময়। ঈদের পর স্কুল-কলেজগুলো খুলুক, অফিস–আদালত–কলকারখানা পূর্ণোদ্যমে চালু হোক, আমরা সবাই যার যার কাজে ফিরে আসি। শুরু হোক কর্মযজ্ঞ! প্রত্যেকে যদি নিজের কাজটুকু ভালোভাবে করি, দেশ তো এগিয়ে যাবেই। বিশ্বের বুকে শান্তি নেমে আসুক, যুদ্ধোন্মাদনা দূর হোক।

আপনাদের সবাইকে জানাই ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।