আজ মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে দেশের ছাত্র-তরুণেরা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। মাতৃভাষার জন্য আমাদের আত্মদান সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। আজ এই দিনটি সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। মাতৃভাষা প্রতিটি জাতির সবচেয়ে প্রিয়। এর পেছনে শুধু আবেগ আছে, তা-ই নয়। এর সঙ্গে আছে আরও বড় অনেক কিছু। যেমন, মাতৃভাষায় দক্ষতা মস্তিষ্কের চিন্তা ও কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটায়, সৃজনশীলতা বাড়ায় প্রভৃতি। এবং এই সব কটির সম্মিলনেই ঘটে এক একটা জাতির আর্থসামাজিক উন্নয়ন।

মাতৃভাষার সঙ্গে একটি জাতির অর্থনৈতিক বিকাশের যোগসূত্র সহজে বোঝা যায় না। মনে হয় ভাষার সঙ্গে অর্থনীতির আবার কী যোগাযোগ, বরং আজকের বিশ্বে ইংরেজি শিখলে বেশি লাভ। বিলাত-আমেরিকায় গিয়ে ভালো চাকরি-ব্যবসা করে আয় বাড়ানো যায়, দেশের উন্নতিতেও কাজে লাগে। এটা ঠিক। কিন্তু বিদেশি ভাষা ইংরেজি ভালোভাবে শেখা যায় যদি মাতৃভাষায় শিশু–কিশোরেরা দক্ষতা অর্জন করে। এ বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে, মাতৃভাষায় অর্জিত দক্ষতা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাতৃভাষায় সুন্দরভাবে পড়তে পারে, এমন শিশুর সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়াতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে।

সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে এমন একজন শিশু যদি মিনিটে অন্তত ৪০টি শব্দ, মানে মাত্র দেড় সেকেন্ডে একটি শব্দ ভালোভাবে পড়তে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সেই শিশু পঠন-দক্ষতা অর্জন করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

আর এ রকম পড়তে পারা শিশুর সংখ্যা যদি মাত্র ১০ শতাংশ বাড়াতে পারি, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারব শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। যদি ১০০ শতাংশ বাড়াতে পারি, তাহলে বাড়বে ৩ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের সব শিশুকে মাতৃভাষায় দক্ষ করে তোলাই এখন আমাদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। করোনায় অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেওয়ার এটি একটি অন্যতম উপায়।

মাতৃভাষায় দক্ষতা আমাদের অন্তত দুটি বিদেশি ভাষা সহজে আয়ত্ত করতে সাহায্য করে। আর তা ছাড়া আমাদের চৌকস করে তোলে। বুদ্ধিমত্তা বা আইকিউ খুব সহজে বাড়িয়ে তোলে। এসব মিলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতিশীলতা পাবে।

বিশ্ব জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশ সহজ

শুধু তা-ই নয়। মাতৃভাষায় দক্ষ শিশুরা খুব সহজে বিশ্ব জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশ করতে পারে। সহজে বিদেশি ভাষা শিখে ওরা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবকিছু আয়ত্তের সুবিধা পায়। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, মাতৃভাষাই মানুষকে সহজে চিন্তাভাবনা করতে শেখায়। মাতৃভাষাতেই মানুষ সবচেয়ে সহজে কল্পনা করতে পারে, স্বপ্ন দেখে। কল্পনা ও স্বপ্ন মানুষকে বড় কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে।
আমাদের বয়স যখন হয়তো এক মাসও না, তার আগে থেকেই মায়ের কোলে মায়ের হাসির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। মা আমাদের অনেক ছবির বই চোখের সামনে রেখে রূপকথার গল্প শোনান। এভাবে আমরা কল্পনার জগতে চলে যাই। সবই মাতৃভাষার কল্যাণে।

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকসের গৃহীত নীতিনির্ধারণী অবস্থানে বলা হয়েছে, জন্মের পর থেকেই পড়াশোনার বিষয়টি প্রাথমিক শিশু পরিচর্যার অংশ হওয়া উচিত। তাই খুব ছোট বাচ্চাদেরও বই পড়ে শোনানোর গুরুত্ব সম্পর্কে মা-বাবাদের সচেতন হতে হবে। শিশুর বয়স দেড়-দুই মাস হলেই তার চোখের সামনে ছবির বই ধরে রেখে ছড়া ও গল্প পড়ে শোনানোর তাত্পর্য গভীর। গবেষণায় দেখা গেছে, এই বাচ্চারা বড় হয়ে অনেক বেশি মেধাবী হয়।

সৃজনশীলতা বৃদ্ধি

জন্মের পর থেকেই শিশু ভাষা না জানলেও মায়ের সঙ্গে কথা বলে, ভাব বিনিময় করে। মায়ের হাসি দেখে শিশু হাসতে শেখে। সে মায়ের মুখের প্রকাশভঙ্গি, আবেগ-অনুভূতিসহ ওই সব শব্দের সামাজিক সম্পর্কসূত্রগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েই সবকিছু শেখে। সুতরাং মাতৃভাষা মানুষের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে। মাতৃভাষা সহজে শেখা যায়, এর জন্য ব্যাকরণ শিখতে হয় না। মাতৃভাষার মাধ্যমে একজন শিশু চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা লাভ করে।

বিস্তৃত পরিসরে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বইয়ের সংস্পর্শে ও বই পড়ে শোনানোর মধ্য দিয়ে বড় করে তোলা শিশুরা পরে সহজে ভাষা শেখে ও স্কুলে বড় বড় সাফল্য অর্জন করে। পেডিয়াট্রিকস জার্নালে ২০১৫ সালের আগস্টে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানা গেছে, যেসব শিশুর বাসায় বেশি বই আছে এবং শিশুকে বেশি বই পড়ে শোনানো হয়, তাদের মস্তিষ্কের বাঁ পাশের অংশ উল্লেখযোগ্য হারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পেরিয়েটাল-টেম্পোরাল-অক্সিপেটাল অ্যাসোসিয়েশন করটেক্স নামে অভিহিত মস্তিষ্কের এই অংশে শব্দ ও চোখে দেখার অনুভূতির সংমিশ্রণ ঘটে। একটু বড় শিশুরা জোরে শব্দ করে পড়লে মস্তিষ্কের এই অংশ উদ্দীপিত হয়।

শিশুচিকিত্সাবিদেরা লক্ষ করেছেন, খুব ছোট বাচ্চাদের বইয়ের গল্প পড়ে শোনালেও একইভাবে মস্তিষ্কের এই অংশ উদ্দীপিত হয়। মায়ের মুখে গল্প শোনার সময় বাচ্চারা মনে মনে কল্পনার জাল বোনে। এভাবে তার সৃজনশীলতা বাড়ে। এরপর কৈশোরে পা দিলে সে তার মেধা, সৃজনশীলতা, বিদেশি ভাষায় দক্ষতা ও আধুনিক বিশ্বের সর্বশেষ অর্জনগুলো সম্পর্কে সহজে ধারণা লাভ করতে পারে। বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে সে কর্মজীবনে প্রবেশ করে। আর্থসামাজিক জীবনে সে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।

আব্দুল কাইয়ুম, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
[email protected]