মুঈন-আশরাফের মামলার রায় যেকোনো দিন

মা ন ব তা বি রো ধী অ প রা ধে র বি চা র
মা ন ব তা বি রো ধী অ প রা ধে র বি চা র

পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে যেকোনো দিন। গতকাল সোমবার এই মামলার বিচারকাজ শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রেখেছেন।এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ৪২ বছর পর বিচারকাজ শেষ হলো। এই মামলায় মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ আনা হয়। ইতিমধ্যে ট্রাইব্যুনাল-২ চারটি মামলার রায় দিয়েছেন।বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২-এ গতকাল এই মামলায় যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়। পরে ট্রাইব্যুনাল বলেন, যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে।এই ট্রাইব্যুনাল গত ২২ সেপ্টেম্বর বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় অপেক্ষাধীন রাখেন।গতকাল মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান ও সালমা হাই প্রথমে ঘটনার বিষয়ে এবং পরে আইনগত বিষয়ে যুক্তি দেন। যুক্তিতে আবদুস শুকুর খান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ যে আশরাফুজ্জামানের কথা বলছে, এই আসামি সেই ব্যক্তি নন। আসামি আশরাফুজ্জামান ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন) সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আলবদরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি ছাত্র সংঘের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন না বলে আলবদরের চিফ এক্সিকিউটরও ছিলেন না।আবদুস শুকুর খান ও সালমা হাই বলেন, মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য ও নথির মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারেনি। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে নির্দোষ দাবি করেন।আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে আইনগত জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে এই দুই আসামির বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে। তিনি মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আরজি জানান। রাষ্ট্রপক্ষ ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন কার্যদিবসে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করে। আসামিপক্ষ যুক্তি দেওয়া শুরু করে ২৯ সেপ্টেম্বর। চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষ মুঈন ও আশরাফের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। পলাতক এই দুজনকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে ট্রাইব্যুনাল দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। তার পরও তাঁরা হাজির না হওয়ায় তাঁদের পলাতক ঘোষণা করে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। তাঁদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের দুজন আইনজীবীকেও নিয়োগ দেওয়া হয়। ২৫ জুন মুঈন ও আশরাফের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ ১৫ জুলাই শুরু হয়ে শেষ হয় ২২ সেপ্টেম্বর। আসামিপক্ষে কোনো সাক্ষী না থাকায় ২৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়।

তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, মুঈন ছিলেন আলবদর বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ এবং আশরাফ ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর। মুঈন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ও আশরাফ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাস করছেন।

১১ অভিযোগ: মুঈন ও আশরাফের বিরুদ্ধে প্রথম থেকে পঞ্চম অভিযোগে রয়েছে, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে দৈনিক ইত্তেফাক-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, ১১ ডিসেম্বর ভোরে পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ-এর প্রধান প্রতিবেদক এ এন এম গোলাম মোস্তফা, ১২ ডিসেম্বর দুপুরে বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ এবং ১৩ ডিসেম্বর শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীনকে অপহরণ করা হয়। মুঈন ও আশরাফের নির্দেশে এবং তাঁদের অংশগ্রহণে আলবদরের সদস্যরা ওই বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের পর হত্যা করে। তাঁদের মধ্যে সেলিনা পারভীন ছাড়া আর কারও লাশ পাওয়া যায়নি।

ষষ্ঠ অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর সকাল আটটা থেকে পৌনে ১০টার মধ্যে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়জন আলবদর সদস্য অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, আবুল খায়ের, ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য ও চিকিৎসক মো. মর্তুজাকে তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে অপহরণ করে। ১৬ ডিসেম্বরের পর মিরপুর বধ্যভূমিতে তাঁদের ছয়জনের লাশ পাওয়া যায়। সিরাজুল হক খান ও ফয়জুল মহিউদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়নি।

সপ্তম থেকে একাদশ অভিযোগে রয়েছে, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও দৈনিক সংবাদ-এর যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সারকে অপহরণ করা হয়। তাঁদের কারও লাশ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক মো. ফজলে রাব্বী এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরীকে অপহরণ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁদের লাশ পাওয়া যায়।

এ মামলার সাক্ষী যাঁরা: এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে যাঁরা সাক্ষ্য দেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে একমাত্র জীবিত ফিরে আসা ও নির্যাতন-হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী দেলোয়ার হোসেন, শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভাতিজা ইফতেখার হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরীর ছোট ছেলে আসিফ মুনীর, ফজলে রাব্বীর মেয়ে নুসরাত রাব্বী, আলীম চৌধুরীর মেয়ে ফারজানা চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিনের বোন ফরিদা বানু, ভাগনি মাসুদা বানু, সিরাজুল হক খানের ছেলে এনামুল হক, আবুল খায়েরের ছোট ছেলে রাশিদুল ইসলাম, মো. মর্তুজার স্ত্রীর বড় ভাই ওমর হায়াত, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর, সৈয়দ নাজমুল হকের ছেলে সৈয়দ মর্তুজা নাজমুল ও ভাই গোলাম রহমান, আ ন ম গোলাম মোস্তফার ছেলে অনির্বাণ মোস্তফা, সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ।