মৃত্যুফাঁদের অভিযাত্রী

এভারেস্ট-চূড়ায় ওয়াসফিয়া নাজরীন, ২৬ মে ২০১২। ছবি: সংগৃহীত
এভারেস্ট-চূড়ায় ওয়াসফিয়া নাজরীন, ২৬ মে ২০১২। ছবি: সংগৃহীত

ওয়াসফিয়া নাজরীনের নিঃশঙ্ক পায়ের ছাপ আমি অনুসরণ করতে শুরু করি ২০১১ সালের অক্টোবর মাস থেকে। বহিরাঙ্গে মাত্র ২৮ বছর বয়সের এক বাঙালি তরুণীর সবটা ছাপ নিয়েও বুকের ভেতরে বিশ্বখ্যাত অভিযাত্রীদের বিক্রম পুষে তিনি উঠে যান আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত কিলিমানজারোর চূড়ায়। অবাক হয়ে খবরটা পড়ি আর ভাবি, কী মেয়ে রে বাবা! এরই দুই মাস পরে, বাংলাদেশের ৪০তম বিজয় দিবসে ওয়াসফিয়া ভয়শূন্যতার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি হয়ে দেশের পতাকা উড়িয়ে দেন লাতিন আমেরিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ অ্যাকানকাগুয়ায়। হকচকিত হয়ে আবার ভাবি, হচ্ছেটা কী!
পর্বতারোহণ নিয়ে আমার দীর্ঘ বছরের ব্যক্তিগত আগ্রহ তখন হঠাৎ এক অদ্ভুত অধীরতায় রূপ নেয়। এর অনেক আগেই জন ক্রাকাউয়ারের বেস্ট সেলার ইনটু থিন এয়ার পড়ার পর থেকে পর্বতারোহণের ঘোর—বিশেষত হিমালয়ের চূড়াগুলো, আরও বিশেষত এভারেস্ট অভিযানকেন্দ্রিক—আমাকে পেয়ে বসেছিল। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম যে আমার নিজের মেয়ে বড় হলে কোনো পর্বতারোহী হবে। সে ঘোরেরই এক তুঙ্গ মুহূর্তে, মনেরই সংহতি থেকে যেন, দেখা হয়ে গেল ওয়াসফিয়ার সঙ্গে। তখন তিনি দুই মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ছোঁয়া সেলিব্রিটি, আর আমি সিটি ব্যাংকের ডিএমডি ও চিফ কমিউনিকেশন অফিসার, অন্য কাজের পাশাপাশি ব্যাংকের ব্র্যান্ড বিল্ডিংয়ের কাজগুলোও দেখি।
প্রথম পরিচয়ে, মনে আছে, অনেক কথা বললাম আমি তাঁর সঙ্গে। সবই পর্বতারোহণ নিয়ে। আরও নিখুঁত করে বললে বিখ্যাত হিমালয় অভিযানগুলোর খুঁটিনাটি নিয়ে—যেমন জর্জ ম্যালোরি, লুকলা, বেসক্যাম্প, থামেলের গরুড় হোটেল, খুম্বু আইসফল, ক্যাম্প ওয়ান, ক্যাম্প টু, হিলারি স্টেপ, ১৯৯৬ এভারেস্ট ট্র্যাজেডি, আনাতলি বুকরিভ, স্কট ফিশার ইত্যাদি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবে যাচ্ছেন এভারেস্টে?’ ওয়াসফিয়া জানালেন, ‘এই মার্চেই।’ অর্থাৎ ২০১২ সালের মার্চে। জানতে চাইলাম, ‘কোন পথ দিয়ে? তিব্বত নাকি নেপাল?’ ওয়াসফিয়া বললেন, ‘ভালোই তো মাউন্টেনিয়ারিংয়ের নেশা আছে আপনার। আমার সাহায্য লাগবে, স্পনসর চাই।’ সোজাসাপ্টা কথার মধ্য দিয়ে প্রথম সাক্ষাৎ শেষ হলো।

noname
noname

কে তাঁকে আমাদের অফিসে নিয়ে এসেছিল আজ তা মনে নেই, কিন্তু মনে আছে যে আমি নিজেকে বলছিলাম, কেউ তাঁকে যদি এই অফিসে নিয়ে না-ও আসত, তবু আমি তাঁকে ঠিকই খুঁজে বের করতাম। রক্তে বাঙালি মেয়ে হয়েও যিনি কিনা এত অকুতোভয়, তাঁর পেছনে স্পনসররা থাকবে, তিনি স্পনসরদের পেছনে নন।
এর পরের গল্প অ্যাকশনে নামার। সিটি ব্যাংক ওয়াসফিয়ার এভারেস্ট অভিযানের প্রধান স্পনসর হলো। ১০ মার্চ ২০১২ তারিখে আমাদের হেড অফিসের ব্যাংকোয়েট হলে বড় একটা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলাম আমরা। ওয়াসফিয়া ব্যাংকের চেয়ারম্যান রুবেল আজিজের হাত থেকে দেশের পতাকা তুলে নিলেন, পর্বতারোহীদের ভাষায় যাকে বলে ‘ফ্ল্যাগ অফ’। তারপরের দিনই তিনি রওনা হয়ে গেলেন নেপালের পথে, তাঁর তৃতীয় মহাদেশ বিজয় ও একই সঙ্গে পৃথিবী নামের এই গ্রহের শীর্ষতম বিন্দু ছোঁয়ার স্বপ্নযাত্রায়। সেই অনুষ্ঠানে, মনে আছে, বক্তৃতায় এভারেস্ট অভিযানের মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে আমি কথা বলছিলাম। সবাই শুনছিলেন তন্ময় হয়ে, কারণ অনেকেই জানতেন না যে এই ‘পাহাড় চড়ার’ মধ্যে আবার এত এত মৃত্যুফাঁদ আছে আর এভারেস্টে ওঠার ওই পথটুকু মোড়ানো রয়েছে, তখন পর্যন্ত, ২১৮ জন পর্বতারোহীর শেষনিশ্বাসের সন্তাপ দিয়ে (যে সংখ্যাসারির ২৪২তম নামটা এখন আমাদের বন্ধু সজল খালেদের, ওয়াসফিয়ারা যে পথে শৃঙ্গ বিজয় করেন, সে পথেরই কোথাও চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে আছেন তিনি।) আমি ওয়াসফিয়াকে বললাম, বেপরোয়া ঝুঁকি নেওয়া যাবে না, এভারেস্টের চূড়া এ বছর ছোঁয়া না হলে না হবে, পরেরবার হবে, কিন্তু সোজা কথা বেঁচে ফিরতেই হবে। মনে আছে, ওয়াসফিয়া অনেক হেসেছিলেন আমার বক্তৃতায় এভারেস্টের পথে মৃত্যুর রোমান্টিসিজমের ফাঁদ এড়িয়ে চলতে বলায়।
এর কদিন পরই আমি কাঠমান্ডুতে, ব্যাংকের তরফ থেকে ওয়াসফিয়ার মূল ‘ফ্ল্যাগ অফ’-এর সাক্ষী হয়ে থাকব বলে। ২৫ মার্চ তাঁর জন্য ‘প্রেস মিট’ আয়োজন করল নেপাল ট্যুরিজম বোর্ড। সেখানে কথা বললেন ট্যুরিজম বোর্ডের ওপরের দিকের কেউ আর ‘এভারেস্ট উইমেন সেভেন সামিটস ইকো-অ্যাকশনের’ শাইলি বাসনেত। বাংলাদেশ থেকে কথা বললাম আমরা ওয়াসফিয়ার বন্ধুরা—রাজা দেবাশীষ রায়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরী, আমি, আরও কেউ কেউ। একই কথা বললাম আবারও, বিপদ এড়িয়ে চলার কথা। পরের দিনই লুকলা, নামচে বাজার হয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্পের পথে রওনা দিলেন ওয়াসফিয়া।
২৫ তারিখ রাতে আমরা সবাই একসঙ্গে, আমাদের পরপর দ্বিতীয় রাতের ডিনারে। সেখানে দেখা হলো ওয়াসফিয়ার একগাদা বইপাগল নেপালি বন্ধুর সঙ্গে। তাঁরা সবাই ব্যতিক্রমহীনভাবে ফ্রানৎস কাফকা আর ইতালো কালভিনোর বিরাট অনুরাগী। ডিনারের শেষে কাঠমান্ডুর রাস্তা ধরে আমরা হাঁটছি, হাসছি, ওয়াসফিয়ার দারুণ আড্ডাবাজি, উচ্ছল হাসি ও প্রাণপ্রাচুর্য দেখে যাচ্ছি; আর ভেতরে-ভেতরে ভাবছি একটা কথাই, মেয়েটা চলে যাবে কাল, পরিষ্কার মৃত্যুতে মোড়ানো পথ ধরে, বরফে চিমসে হয়ে থাকা বহু বছরের মৃতদেহগুলো হয় বাঁয়ে না হয় ডানে রেখে। খোদা, মেয়েটা যেন জীবিত ফিরে আসে। ফিরে আসে যেন তাঁর স্বপ্ন পূরণ করেই।
এরপর তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয় ফোনে। তত দিনে তাঁর এভারেস্ট বিজয় শেষ। সম্ভবত ক্যাম্প টুতে ফিরে এসেছেন তিনি, সম্ভবত মৃত্যুকে দেখে এসেছেন মাত্র এক নিশ্বাসের দূরত্ব থেকে। মনে আছে, তাঁর উচ্ছ্বাসভরা আনন্দ-চিৎকারের কথা, ‘মাসরুর ভাই, বেঁচে আছি। সামিট করা শেষ। ভালো আছেন তো আপনারা?’
সেই ওয়াসফিয়া এখন সাত মহাদেশেরই সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করা প্রথম বাংলাদেশি ও প্রথম বাঙালি নারী। আমি আজও অনুসরণ করি তাঁর উদ্দাম পায়ের ছাপ, যে ছাপের সমস্ত রেখা নকশা করা অসীম সাহস ও নির্ভাবনার অরুণ রঙে।
মাসরুর আরেফিন: লেখক ও অনুবাদক; ব্যাংকার।