ঈদের আগের দুই দিনে প্রতিদিন গড়ে ২৫ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ে। অথচ দেশের মূল গণপরিবহন বাস, ট্রেন ও লঞ্চে দিনে যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা আছে সাড়ে ১০ লাখের মতো। চাহিদা ও জোগানের এই বিরাট পার্থক্যের সুযোগে দুই দিন ভাড়া নিয়ে চলে নৈরাজ্য। এবার পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই বাড়তি যাত্রীর চাপ শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে বাসভাড়ায় শুরু হয়েছে নৈরাজ্য।
ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, কোনো কোনো বাসে নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ আদায় করা হচ্ছে। বাসগুলোয় মোড়া দিয়ে, চালকের পাশে গাদাগাদি করে বসিয়ে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে।
বিআরটিএর হিসাবে, গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। এই রুটে সরকার–নির্ধারিত ভাড়া ১২৬ টাকা। এই রুটে চলাচল করে সেলফি পরিবহন। গতকাল এই বাসের কর্মীরা ‘পাটুরিয়া ৩০০’ বলে ভাড়া হেঁকেছেন।
সেলফি পরিবহনের মতো অধিকাংশ পরিবহনের ভাড়া দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। চন্দ্রা মোড়ে সিরাজগঞ্জের আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, উল্লাপাড়া পর্যন্ত স্বাভাবিক সময়ে ২৫০ টাকায় যেতেন। গতকাল ৫৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। বগুড়ার আলতাফ হোসেনের দাবি, তিনি আগে ৪০০ টাকায় যেতেন। গতকাল তাঁকে ৮০০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়েছে। চন্দ্রা থেকে বগুড়ার দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এই রুটে ৪০ আসনের ভাড়া ৪১৪ টাকা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়তি ভাড়া যাতে আদায় না হয়, সে জন্য আমরা লোক নামিয়েছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে বাসে যাতায়াত বেড়েছে। উত্তরাঞ্চল ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষেরও মূল যাতায়াত বাসে। গত ঈদুল ফিতরে দূরপাল্লার পথে বিপুল যাত্রী ঝুঁকি নিয়ে মোটরসাইকেলে বাড়ি গেছেন। এবার সরকার ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। এ সুযোগে বাস মালিক–শ্রমিকেরা ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) বাসের ভাড়ার ক্ষেত্রে একধরনের নৈরাজ্য চলছে। পদ্মা সেতু হয়ে বরিশালে ৪০ আসনের বাসে সরকার–নির্ধারিত ভাড়া ৪৫৪ টাকা। একই রুটে এসি বাসের ভাড়া এক হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। অথচ সাধারণ মানের বাসে শুধু এসি লাগিয়ে দ্বিগুণের বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
পরিবহন–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার এসি বাসের ভাড়া ঠিক করে দেয় না। এ জন্য পরিবহনমালিকেরা ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করেন। আবার বড় কোম্পানির বাইরে অন্যান্য পরিবহন অগ্রিম টিকিট বিক্রি করে না। যাত্রার আগে আগে যাত্রীদের কাছ থেকে কর্মীরা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে।
গতকাল দুপুরে গাবতলীতে রেখা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি কোম্পানির কাউন্টারের সামনে বসে রংপুরের এসি বাসের টিকিট ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা এক কর্মী দাবি করেন, ঈদে খরচ বেশি, তাই ভাড়া বেশি নিচ্ছেন।
বিআরটিএর হিসাবে, এই রুটের দূরত্ব ৩০৮ কিলোমিটার। স্বাভাবিক সময়ে এই রুটে ভালো মানের এসি বাসের ভাড়া ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। আর নন–এসি ৪০ আসনের বাসের সরকার–নির্ধারিত ভাড়া ৭৪১ টাকা।
রেখা পরিবহনের পাশেই শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার। সেখানে ঢাকা–নওগাঁ পথে বিআরটিসির নন–এসি বাসের টিকিট ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। বিআরটিএর হিসাবে, ঢাকা থেকে নওগাঁর দূরত্ব ২৪৩ কিলোমিটার। ৪০ আসনের বাসের নির্ধারিত ভাড়া ৫৯২ টাকা।
কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা শওকত আলী বলেন, শ্যামলী পরিবহনের বাসের টিকিট নেই। তাঁরা বিআরটিসির বাস ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন। বিআরটিসি তাঁদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। তাই তাঁরাও ভাড়া বাড়িয়েছেন।
সাতক্ষীরা রুটের সুন্দরবন এক্সপ্রেস ভাড়া নিচ্ছে ১ হাজার টাকা। এই রুটের দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। সরকার–নির্ধারিত ভাড়া ৮০২ টাকা। কাউন্টারে বসে যাত্রী শেখ জায়েদ হোসেন বলেন, তাঁরা পাঁচজন যাবেন। চারজনের আসন দেবে, একজন যাবে সুপারভাইজারের আসনে বসে। ভাড়া এক হাজার টাকা।
ঢাকা থেকে কত বাস চলে
ঢাকা থেকে তিনটি টার্মিনাল দিয়ে বিভিন্ন জেলায় মানুষ যাতায়াত করে। বিআরটিএর হিসাবে, গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী—এই তিন টার্মিনাল থেকে ১৭ হাজার ৮৪১টি বাস চলাচলের অনুমোদন আছে। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা হয়ে যায় ৪ হাজার ১৭৯টি বাস। আর ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় চলে আরও ৫৬৫টি বাস। সব মিলিয়ে ঢাকা হয়ে চলাচল করে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার বাস। এসব বাসে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা আছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের আগের দুই দিন যত মানুষ ঢাকা ছাড়ে, তার তিন ভাগের এক ভাগ পরিবহনের সক্ষমতা আছে আমাদের গণপরিবহনের।’
বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, ঈদে কত মানুষ ঢাকা ছাড়ে, তা সরকার জানে। কিন্তু সক্ষমতা কত, তার কোনো বিশ্লেষণ নেই। জোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে ভাড়ানৈরাজ্য ও টিকিট কালোবাজারি হবে। এটি বন্ধের দায়িত্ব সরকারের।
পরিবহন সক্ষমতা বাড়াতে হাদিউজ্জামানের পরামর্শ—পরিকল্পনা করে ঈদের ছুটি দীর্ঘায়িত করা। পোশাক কারখানার ছুটি পরিকল্পনামতো দেওয়া হয়েছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা। প্রয়োজনে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ব্যবহৃত বাস ঈদে যাত্রী পরিবহনে লাগানো যেতে পারে।
টিকিট কালোবাজারি
পরিবহন খাতের সূত্রগুলো জানায়, ঈদ উপলক্ষে বড় কিছু পরিবহন কোম্পানি অগ্রিম টিকিট বিক্রি করে। সেই টিকিট ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত একটি চক্র এই টিকিটের একটা অংশ কিনে রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে। শেষ দিকে তারা চড়া দামে এসব টিকিট কালোবাজারে বিক্রি করে।
বাড়তি ভাড়া রোধে নেই সরকারি উদ্যোগ
প্রতিবছর ঈদযাত্রার আগে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রস্তুতি সভা করে। ওই সভায় সড়ক–মহাসড়ক নির্বিঘ্ন রাখার বিষয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়। বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়টি সেভাবে জোর পায় না। এবার বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে ২১টি বিষয় ছিল। একটিতেও বাড়তি ভাড়া আদায় রোধের বিষয়ে তেমন কিছু বলা হয়নি।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিবছরই ঢাকার তিনটি বাস টার্মিনালে তদারকি ডেস্ক বসানো হয়। এবারও বসেছে। এতে বিআরটিএ, মালিক–শ্রমিক প্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থাকেন। এর বাইরে টার্মিনাল ও আশপাশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসেছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখা। যানবাহনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখা। বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে খুব একটা তৎপরতা দেখা যায় না।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার টার্মিনালগুলোয় তাদের তদারকি দল কাজ করছে। বাড়তি ভাড়ার অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঈদে যত মানুষ ঢাকা ছাড়ে
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে, ঈদে ১ কোটি ১৫ লাখের মতো মানুষ ঢাকা ছাড়ে। পরিবহন মালিক–শ্রমিক ও বিআরটিএ সূত্র বলছে, ঈদের মূল চাপ দুই থেকে আড়াই দিনের। এবার ঈদুল আজহার মূল চাপ পড়ছে শুক্র ও শনিবার। এই দুই দিনে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গত ঈদুল ফিতরের পর তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছিলেন, ওই ঈদে ঘরমুখী প্রায় এক কোটি মানুষ রাজধানী ছেড়েছিল। মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে যতগুলো সিমকার্ড ঢাকার বাইরের টাওয়ারে ব্যবহার করেছে, এর ওপর ভিত্তি করে তিনি এই হিসাব দিয়েছিলেন।