যুদ্ধদিনে ইউক্রেনপ্রবাসী বাংলাদেশিদের ঈদ

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কেন্দ্রীয় মসজিদছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কেন্দ্রীয় মসজিদটি লুকিয়ানোস্কা নামের জায়গায়। সেখানে ১০ হাজার মানুষের একবারে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা আছে। আজ সোমবার ইউক্রেনে ঈদের দিনে হাজার তিনেক মানুষ ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৮ জনের মতো ছিলেন বাংলাদেশি। যুদ্ধদিনের এমন ঈদ তাঁদের কারও জীবনে কখনো আসেনি। এসব বাংলাদেশির বেশির ভাগই দুই থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ইউরোপের এ দেশটিতে আছেন। সেখানে ঈদ বাংলাদেশিদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগও করে দেয়। এবারও দিয়েছে। কিন্তু এবার তাঁরা সংখ্যায় কম। মনের মধ্যেও অস্বস্তি।

কিয়েভ নগরে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ বাংলাদেশির বাস ছিল। তবে এখন ৩০ জনের মতো আছেন।

আজ যেসব বাংলাদেশি কেন্দ্রীয় মসজিদে ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছেন তাঁদের মধ্যে হাসিনুল হক, খালেদ মোশাররফ ও সাখাওয়াত হোসেন পাশাপাশি বসে নামাজ আদায় করেছেন। হাসিনুল হক থাকেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের নিভকি এলাকায়। এটি রাজধানীর প্রায় কেন্দ্রস্থলের একটি জায়গা।

কিয়েভের মসজিদের পাশে মো. হাবিবুর রহমান (বাঁ) ও মো. আবদুল জব্বার
ছবি: সংগৃহীত

আজ বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টার দিকে কথা হয় হাসিনুল হকের সঙ্গে। ততক্ষণে তাঁদের ঈদের নামাজ শেষ হয়েছে। ফোনে তিনি যখন কথা বলছিলেন তখন ‘ঈদ মোবারক’ জানাচ্ছিলেন আশপাশের অন্যদের। হাসিনুল জানান, ঈদের দিন সরকারি ছুটি নেই ইউক্রেনে। তবে কেউ চাইলে ছুটি নিতে পারেন।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর এ নগরীর বাসিন্দাদের অর্ধেকের বেশি চলে গিয়েছিলেন। রাশিয়ার হামলা শিথিল হওয়ার পর অনেকেই ফিরে এসেছেন। তবে হাসিনুল যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও কিয়েভ ছাড়েননি। হাসিনুল বলছিলেন, ‘এখন কিয়েভের পরিস্থিতি অনেক ভালো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সবকিছু খুলে গেছে। তবে যুদ্ধের একটি প্রভাব তো আছেই।’

স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে হাসিনুলের সংসার। স্ত্রী ইউক্রেনের নাগরিক। আগের ঈদের চেয়ে এবারের ঈদটি হাসিনুলের কাছে ভিন্ন, কারণ এবার লোকসমাগম কম। তিনি বলছিলেন, ‘এই ঈদের দিন দেশের মানুষের সঙ্গে দেখা হতো। অনেকের বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া হতো। এবার লোকজন অনেক কমে গেছে। অনেকেই ইউক্রেন ছেড়েছেন। তবু এর মধ্যে যারা আছি, তারা আনন্দ ভাগাভাগি করার চেষ্টা করছি।’

এই ঈদের খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো সেমাই। হাসিনুল জানান, এখানে খুব সরু এক ধরনের পাস্তা সেমাই হিসেবে রান্না হয়। দেশের মতো সেমাই পাওয়া যায় না।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে কোরবানির ঈদে বাংলাদেশে এসেছিলেন হাসিনুল। তারপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি। দেশের ঈদের আনন্দের সঙ্গে ইউক্রেনের ঈদের কোনো তুলনা নেই বলে আক্ষেপ করেন তিনি। তাঁর ভাষ্যমতে, দেশে যেমন আনন্দ–উচ্ছ্বাসে ভরপুর থাকে, এ দেশে তেমনটা নেই।

হাসিনুলের মতো খালেদ মোশাররফও বাংলাদেশের ঈদের সঙ্গে ইউক্রেনের ঈদের বড় ফারাকের কথা বলেন। খালেদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে। খালেদ কিয়েভে ব্যবসা করেন। বিয়ে করেছেন ইউক্রেনের এক নারীকেই। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।

খালেদ মোশাররফ বলছিলেন, ‘ঈদুল ফিতরের আগে বাংলাদেশে নতুন জামা কেনাকাটার এক উৎসব শুরু হয়। এখানে কিন্তু তা পাবেন না এবং এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে আমরা কেউ কেউ বাচ্চাদের নতুন জামাকাপড় কিনে দিই। এবারও দিয়েছি। তবে নিজের জন্য কিছু কিনিনি।’

যুদ্ধ পরিস্থিতি এবার ঈদের আনন্দ অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে বলে জানান খালেদ মোশাররফ। তিনি জানান, এর আগে ২০১০ সালে বাংলাদেশে সর্বশেষ ঈদ করেছিলেন। দেশের ঈদের স্মৃতি তাঁকে টানে অনেকটাই।

ইউক্রেনের মসজিদে ঈদের জামাত শেষে তিন বাংলাদেশি (বাঁ থেকে) সাখাওয়াত হোসেন, হাসিনুল হক ও খালেদ মোশাররফ
ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশি যুবক মোহাম্মদ তাইয়েব। গত মাসে রাশিয়া কিয়েভ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে পূর্ব ইউক্রেন দখলের দিকে মনোযোগী হওয়ার ঘোষণা দিলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন তিনি। এই ছেলেকে নিয়ে আজ ঈদের নামাজ আদায় করেছেন কিয়েভের আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনি থাকেন কিয়েভের নিপ্রোস্কি এলাকায়। হাবিবুর রহমানের বাড়ি বাংলাদেশের গাজীপুরে।

হাবিবুরের ছেলে এখন বাড়িতেই থাকছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা ছিল। এর জন্য তাইয়েবের যুদ্ধে যাওয়া। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি শিথিল হওয়ার পর অল্প বয়সীদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। হাবিবুর রহমান বলছিলেন, ‘এমন ঈদ দেখি নাই। করোনার কারণে গেল দুই বছরের ঈদে লোকসমাগম কম হতো। ভেবেছিলাম এবার বেশি হবে। তবে যুদ্ধ তা হতে দিল না।’

তবে কিয়েভের পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো বলে জানান হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কিয়েভের অবস্থা কোনো সময়েই যে খুব বেশি খারাপ ছিল, তা নয়। এখন পরিস্থিতি অনেক শান্ত।’

কিয়েভের মসজিদে ঈদের জামাত
ছবি: সংগৃহীত

দেশের মতো আয়োজন না হলেও বাসায় ভালো-মন্দ খাবারের আয়োজন করেছেন বলে জানান হাবিবুর রহমান। তিনি দুই ছেলের বাবা। স্ত্রীসহ ছোট ছেলেকে তিনি শ্বশুরবাড়ি ইউক্রেনের গ্রামের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন বড় ছেলেকে নিয়েই আছেন। আপাতত যুদ্ধ থেকে ফিরে এলেও তাঁর ছেলেকে আবার যুদ্ধে যেতে হতে পারে বলে জানান হাবিব।

কিয়েভের পিচেস্কিরায়ন এলাকায় থাকেন বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ির বাসিন্দা মো. আবদুল জব্বার। তিনি ইউক্রেনে আছেন ৩১ বছর ধরে। বাসার কাছেই একটি স্কুলে চাকরি করেন তিনি। আজ সকালে ছুটেছিলেন কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজ পড়তে।

সরকারি ছুটি না থাকলেও চাইলে ছুটি নিতে পারতেন, কিন্তু নেননি। আবদুল জব্বার বলেন, অন্যান্য বছর ঈদের দিন বাংলাদেশিদের আড্ডা হয়। এবার তেমন আয়োজন নেই। আজ ঘটনাক্রমে তাঁর মেয়ের জন্মদিন। কিন্তু সেই উৎসবও আনন্দে করতে পারছেন না।

আবদুল জব্বার বলছিলেন, ‘এবার সেই আনন্দ নেই। কিয়েভ কিছুটা হলেও শান্ত। কিন্তু দেশ যুদ্ধে থাকলে কি মন ভালো থাকে?’