রক্ষা করতে না পেরে সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছে ট্রাস্ট

গত ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেলেও সেখানে এখন শ্রমিকদের বসবাস। গতকাল রাজধানীর ওয়ারীর কে এম দাস লেনে
ছবি: প্রথম আলো

২২ বছর আগে রাজধানীর কে এম দাস লেনে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পত্তির ১০০ শতক জমিতে ছিল হরদেও গ্লাস অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কসের তিনটি শ্রমিক কলোনি। এই দুটি প্রতিষ্ঠান ১৯৯০ সালে বন্ধ হয়ে যায়, শ্রমিকদেরও ছাঁটাই করা হয়। কিন্তু শ্রমিকেরা সেখানেই তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা করে নেন। শুধু শ্রমিকেরা নন, সেখানে ১৪ শতক জায়গার ওপর একটি টিনশেডে থাকছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাও।

এভাবে সারা দেশেই মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের জমি বেহাত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব জমি কার বা কাদের দখলে রয়েছে, তা–ও অনেক ক্ষেত্রে ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের জানা নেই।

স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ও দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত না নিতে পারায় কল্যাণ ট্রাস্টের নামে বরাদ্দ থাকা জমির আজ এমন দশা। এ অবস্থায় এসব জমি বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে না দিয়ে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে কল্যাণ ট্রাস্টের এসব সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, তাঁরা কল্যাণ ট্রাস্টের মালিকানাধীন জমির স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখেছেন, জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, এসব জমি বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে দেওয়া হলে তা বেহাত হবে না। জনস্বার্থে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়ায় জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়, একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের জমির মূল্য ঠিক করা হবে।

আরও পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কল্যাণ ট্রাস্টের জমি রক্ষা করতে পারছি না। যে যেখান দিয়ে পারছে দখল করছে। যেমন রাজধানী সুপার মার্কেট আমাদের আয়ত্তে আছে বলে মনে হয় না। আমরা শুধু নামকাওয়াস্তে ভাড়া পাই। এ ছাড়া এসব সম্পত্তিতে যারা থাকে বা যাদের দখলে আছে, তাদের উচ্ছেদ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কেউ জায়গা খালি করে না। আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসে।’

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭২ সালে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট তার অধীনে দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে আয় করবে। সেই আয় দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মসংস্থান ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে, এটাই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি বলা যায়।
জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ টাস্ট্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

যেখানে যত জমি হস্তান্তরের সুপারিশ

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্রে জানা গেছে, ৪ নম্বর হাটখোলায় হরদেও গ্লাস অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস কারখানার জমির পরিমাণ ২৬ দশমিক ৯৫ একর। সেখানে দোতলার পুরোনো ভবন ও টিনশেড ঘরে ট্রাস্টের সাবেক কর্মচারী, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৪টি পরিবার বাস করছে। হরদেও গ্লাস অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কসের কে এম দাস লেনের চারটি ঠিকানায় প্রায় এক শ শতক জমিতে ১৯৯৯ সাল থেকে এসব স্থানে কারখানা না থাকার পরও সেখানেই বসবাস করছেন শ্রমিকেরা। এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসিক সমস্যা নিরসনে ভবন নির্মাণের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে জমি হস্তান্তর করা যেতে পারে।

মিরপুরের তাবানী বেভারেজ কোম্পানি লিমিটেডের জমির পরিমাণ ৭ দশমিক ২৫ একর। তিন বছর ধরে এই জমি ভাড়া দেওয়া হয়েছে টিভিএস অটো বাংলাদেশকে, মাসে প্রায় ২৩ লাখ টাকায়। সুপারিশে বলা হয়েছে, কল্যাণ ট্রাস্টের এ জায়গায় একটি পঙ্গু হাসপাতাল করার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।
২৫৫ তেজগাঁও শিল্প এলাকার এক একর জমি মাসিক ১২ লাখ টাকায় তিন বছরের জন্য ভাড়া দিয়েছে ট্রাস্ট।

একইভাবে ২৭৩-৭৬ তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে সিরক্কো সাবান অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জমিও মাসিক সাড়ে ১৭ লাখ টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। এ দুটি জমির ব্যাপারে সুপারিশে বলা হয়েছে, জমিগুলোতে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস এবং ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট অবস্থিত। এসব জমিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হল নির্মাণের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া যেতে পারে।

তেজগাঁও মেটাল প্যাকেজেস লিমিটেডের দুই একর জমিতে আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নির্মাণ, গাজীপুরের ইউনাইটেড টোবাকো কোম্পানির ১ দশমিক ৭৭ একর পড়ে থাকা খালি জমিতে আঞ্চলিক অফিস নির্মাণের জন্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। টঙ্গীর বাংলাদেশ গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের খালি পড়ে থাকা ১ দশমিক ৭৭ একর জমিতে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে হস্তান্তর করার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ ছাড়া গাজীপুরের কুনিয়া মৌজার ২ দশমিক ৬৮ একর জমিটি গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে তিন বছরের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছে। জায়গাটি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আবর্জনা ফেলার ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই এ জমি গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে দিয়ে দিতে সুপারিশ করা হয়েছে।

চট্টগ্রামের ইস্টার্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ১০ দশমিক ১ একর জমি ও রাঙ্গুনিয়ার ১৫ একর জমি আন্তর্জাতিক মানের মৎস্য হ্যাচারি ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য মৎস্য অধিদপ্তরকে হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব স্থানে অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের মাল্টিপল জুস কনসেনট্রেট প্ল্যান্টের ৫ দশমিক ৬ একর জমি খাদ্য অধিদপ্তরকে, দেলোয়ার পিকচারস লিমিটেডের জমি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে বাক্সলি পেইন্টস লিমিটেডের প্রায় দুই একর জমি লাভজনকভাবে পরিচালিত হওয়ায় ট্রাস্টের অধীনেই রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গতকাল সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেভাবে কল্যাণ ট্রাস্টের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে, তাতে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমরা সরকারি সংস্থার কাছেই এসব জমি বিক্রি করব। পড়ে থাকা এসব সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।’

গত ৪ মার্চ জাতীয় সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী জানান, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মোট সম্পদের পরিমাণ ৩৯১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্থায়ী সম্পদ ১ কোটি ৬১ লাখ, বিনিয়োগ (এফডিআর) ২৩৪ কোটি ৭৫ লাখ ও চলতি সম্পদ ১৫৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এ বিপুল সম্পদ নিয়েও ট্রাস্টের আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। সম্পদশালী ট্রাস্টের জমি আছে প্রায় ৭০ একর। ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এই জমির বাজারমূল্য অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা। তবে সম্পদের তুলনায় আয় খুব সামান্য।

কল্যাণ ট্রাস্টের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিজেদের পরিচালনায় সচল আছে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান। একসময়ের লাভজনক প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা উৎপাদনকারী তাবানী বেভারেজও বন্ধ হওয়ার পর ভাড়া দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের টিকে থাকা একমাত্র প্রতিষ্ঠান পূর্ণিমা ফিলিং অ্যান্ড সার্ভিস স্টেশন। এ প্রতিষ্ঠানকেও ২০১৯ সালে ভাড়া দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, ভাড়া দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে অলাভজনক প্রমাণের চেষ্টা করে একটি গোষ্ঠী।