রাজাকারি নির্মমতা

১৬ ডিসেম্বর সারা দেশ বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠলেও এর ১০ দিন আগেই ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় মুদাফ্ফরগঞ্জ। চাঁদপুরের পূর্ব শেষ সীমান্তে কুমিল্লার শুরুতেই মুদাফ্ফরগঞ্জ ইউনিয়ন। ওই এলাকার দামাল ছেলেরা জীবন বাজি রেখেই পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করেন মুদাফ্ফরগঞ্জকে। ওই দিন ভোরেই পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যায় চাঁদপুরের দিকে। এরপর পুরো মুদাফ্ফরগঞ্জে আনন্দের জোয়ার বইতে থাকে। কিন্তু এর কদিন পরই ১৩ ডিসেম্বর রাত তিনটায় এ আনন্দকে ম্লান করে দেয় এলাকার কিছু রাজাকার।

স্থানীয় ব্যবসায়ী খোকন কর্মকার জানান, ওই রাতে চিকনিয়া গ্রামের নগরীপাড়া কামারবাড়ির ১০ হিন্দু ও একজন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে মুদাফ্ফরগঞ্জ-লাকসাম সড়কের পাশে একটি বটগাছের নিচে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে রাজাকাররা। পরে একটি গর্তের ভেতর একসঙ্গে সবাইকে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাটির নিচ থেকে ১১ জনের কঙ্কাল বের করেন স্থানীয় লোকজন। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আজও মুদাফ্ফরগঞ্জবাসী এ হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে শোককাতর হয়। তাঁদের কারও নাম আজও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের তালিকায় ওঠেনি। তাঁদের জন্য গড়ে ওঠেনি কোনো শহীদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভ। তাঁদের স্ত্রীদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা বিধবা ভাতাও পান না।
মুদাফ্ফরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তৎকালীন কৃষি ব্যাংক বিজরা শাখার ম্যানেজার আবু আহমেদ তালুকদার। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর আমরা সংগঠিত হতে থাকি। ’৭১ সালের এপ্রিল ও মে মাসে ভারত থেকে ২৫ দিনের ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরি। ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে অপিস চিতোষী এলাকায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প করি। আমাদের কমান্ডার ছিলেন আইয়ুব আলী ও আবদুল গনি। মে মাসের শুরুর দিকে পাকিস্তানি বাহিনী মুদাফ্ফরগঞ্জে তাদের আস্তানা গাড়ে। শুরু হয় তাদের ধ্বংসযজ্ঞ। তাদের সঙ্গে রাজাকার হিসেবে যোগ দেয় মোশারফ হোসেন, আরিফুর রহমান, আলী আজ্জমসহ বেশ কয়েকজন। তারা মুদাফ্ফরগঞ্জের হলুদিয়া, চুমরিয়া, লক্ষ্মীপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের বাড়িঘরে আগুন দেয়। লুটপাট করে। হানাদাররা প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে ৫-১০ জনকে ধরে এনে কাগৈয়ার পুলের ওপর নিয়ে হত্যা করে তাজন খালে ফেলে দিত। একপর্যায়ে আমাকে পাকিস্তানি সেনারা তাদের ক্যাম্প মুদাফ্ফরগঞ্জ হাইস্কুলের ভেতর তহশিল অফিসে নিয়ে আটকে রাখে। ৫ ডিসেম্বর রাত তিনটায় মুক্তিযোদ্ধারা মুদাফ্ফরগঞ্জ বাজারের পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করে আমাকে উদ্ধার করেন। এ সময় তাঁদের গুলিতে একজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাকিরা চাঁদপুরের দিকে পালিয়ে যায়। সহযোদ্ধারা রাজাকারদের দুটি বাংকারে হামলা চালান। এ সময় লুকিয়ে থাকা ১২ জন রাজাকারের মধ্যে ১০ জন নিহত হয়। বাকি দুজন পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে ভারতীয় সেনারা পেছন থেকে সহায়তা করে।’
মুদাফ্ফরগঞ্জ জামে মসজিদে ৪৮ বছর ধরে ইমামতি করছেন মো. শামছুল হক। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা যখন এলাকায় ঢুকত, তখন আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম। ওই সময় স্থানীয় অনেকেই তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মানুষের দোকানপাট বাড়িঘরে হামলা চালায়। এ ভয়ে অনেকেই বাড়িঘর ও দোকানপাট ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসে।’