রামরঞ্জন ভট্টাচার্য

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন

স্কেচ: আনোয়ার হোসেন
স্কেচ: আনোয়ার হোসেন

সিলেটের খ্যাতনামা ও প্রবীণ আইনজীবী ছিলেন রামরঞ্জন ভট্টাচার্য। একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল সত্তরেরও বেশি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি শহর ছেড়ে বালাগঞ্জের পেয়ারাপুর গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
২৬ মে সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে একজন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি সেনা পেয়ারাপুর গ্রামে ঢোকে। তাদের পথ দেখিয়ে আনে বাঙালি আবদুল আহাদ চৌধুরী। গ্রামবাসীকে সে জানায় যে তারা এসেছে গ্রামে শান্তি কমিটি গঠন করতে। কিন্তু তার ডাকে কেউ সাড়া না দিলে মুসলিম লীগের নেতারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে সবাইকে আশ্বস্ত করে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ছয়েক উদ্দিন মাস্টার।
তারা গ্রামের সমস্ত হিন্দু-মুসলমানকে এক স্থানে একত্র করে। সেখানে হিন্দু-মুসলমানদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়। কিছুক্ষণ পর শুধু হিন্দুদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনারা। ওই দলে ছিলেন রামরঞ্জন ভট্টাচার্য। প্রায় ৮০ (মতান্তরে ৭৩) জনকে পাকিস্তানি সেনারা সেদিন হত্যা করে। পরে তাঁদের গণকবরে মাটিচাপ দেওয়া হয়। সিলেটের আইনজীবীদের মধ্যে তিনিই প্রথম শহীদ হন। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থর ‘আমার আপনজন’ রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বৃহত্তর সিলেট জেলায় অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে নির্বিবাদে হত্যা করা হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় এডভোকেট রামরঞ্জন ভট্টাচার্যও একজন।...
‘২৭ মার্চ মির্জাজাঙ্গাস্থ নির্বাক আশ্রম আক্রমণ এবং রামবিহারী ধর ও পাঁচু সেনকে হত্যার খবরে তিনি মর্মাহত হন এবং নিজ নিরাপত্তার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। কিন্তু তখন সিলেট শহর ছেড়ে বের হবার উপায় ছিল না। একেবারে বদ্ধদশায় এপ্রিল মাস পর্যন্ত তাঁকে থাকতে হয়। অতঃপর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি বালাগঞ্জ থানার [বর্তমানে উপজেলা] বুরঙ্গ বাজার ইউনিয়নের পেয়ারাপুর গ্রামে আসেন। সে সময় তিনি জেলা জজকোর্টের পেশকার নিকুঞ্জবিহারী দেবরায়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ২৬ মে সকাল দশটায় একজন পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে কয়েক গাড়ি পাকসেনা পেয়ারাপুরে আসে। এই বাহিনীকে পেয়ারাপুরে আনে জনৈক আবদুল আহাদ চৌধুরী। এই আবদুল আহাদ চৌধুরী স্থানীয় বাসিন্দাদের জানায় যে পাকসেনারা এখানে এসেছে শান্তি কমিটি গঠন করতে। এলাকাবাসী যাতে নিশ্চিন্তে অবাধে চলাফেরা করতে পারে, তার জন্য প্রত্যেকের নামে একটি করে পরিচয়পত্র ইস্যু করা হবে। লোকজনের সহায়তা করার জন্য আহ্বান জানালে কেউ কোনো সাড়া দেয় না। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে এলাকাবাসীদের ধরে নিয়ে আসে। এলাকাবাসীদের ধরে আনার ব্যাপারে ছয়েক উদ্দিন মাস্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। দলে দলে হিন্দু-মুসলমানদের নিয়ে এসে হিন্দু ও মুসলমান হিসেবে আলাদা দুই ভাগে বিভক্ত করে। সারিবদ্ধ করার সময় প্রত্যেককে বেঁধে ফেলে। তারপর শুরু করে ফায়ার। এডভোকেট রামরঞ্জনকেও তারা হত্যা করে অন্য আশিজন বাঙ্গালী পুরুষের সাথে।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, পঞ্চম খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯২, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
রামরঞ্জন ভট্টাচার্যের পৈতৃক নিবাস মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার নর্তন গ্রামে। থাকতেন সিলেট শহরের কাষ্টঘর মহল্লায়। স্থানীয় জেলা বার ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র। অ্যাডভোকেট হিসেবে তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শান্ত, ধীরস্থির ও অন্তর্মুখী মানুষ ছিলেন তিনি। অনেক দরিদ্র মানুষের মামলা তিনি কোনো ফি না নিয়ে পরিচালনা করেছেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না ভট্টাচার্য।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (অষ্টম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৯) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]