লাঠিটিলা সাফারি পার্কের প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা

দেশের অন্যতম ক্রান্তীয় চিরসবুজ ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনভূমি হচ্ছে লাঠিটিলাছবি: শিমুল তরফদার

মৌলভীবাজারের জুড়ীর লাঠিটিলায় প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক তৈরির কাজ শুরু করা হবে।

পরিবেশকর্মীরা মনে করেন, উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক তৈরি করা হলে এটি পরিবেশের জন্য সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করবে। অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্যের বিলোপ ঘটবে। সরকারের অর্থের অপচয় হবে। লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক নির্মাণের তৎপরতা পুরোপুরি বন্ধ করার দাবি করা হয়েছে।

এর আগে গত বছরের জুনে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল সার্ভিসেস লিমিটেড (বিইটিএস) সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক করার পক্ষে মতামত দিয়েছে। বিইটিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক করা অযৌক্তিক হবে না।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সাফারি পার্ক করার পক্ষে মতামত দেওয়ার পর প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। প্রায় ৬ মাস ধরে লাঠিটিলার ২৭০ একর জায়গাজুড়ে প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক অযৌক্তিক হবে না বলার পর গত এপ্রিলে মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব দাখিল করা হয়েছে। এরপর আর কিছু হচ্ছে না। প্রকল্প অনুমোদন করা হলে কার্যক্রম শুরু হবে। গাছ, পাহাড় না কেটে খালি জায়গায় সাফারি পার্ক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্প প্রস্তাবে হাতি, বাঘ, সিংহ, ভালুক, গন্ডার, গয়াল, জলহস্তী, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, কুমির, হরিয়াল ইত্যাদি বন্য প্রাণী সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া সেগুলোর বসবাস ও প্রজননের জন্য উপযুক্ত স্থান, সাফারি পার্কের প্রাণীসহ সব ধরনের বন্য প্রাণীর চিকিৎসায় পশু হাসপাতাল নির্মাণ, সাফারি পার্ক পরিচালকের কার্যালয় ও বাংলো এবং স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।

লাঠিটিলার মতো উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনার বিপক্ষে পরিবেশকর্মীরা। তাঁদের বক্তব্য, লাঠিটিলা একটি সংরক্ষিত বনভূমি। এখানে কেবল সাফারি পার্কই নয়, কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণেরই সুযোগ নেই। এখানে সাফারি পার্ক করা হলে বনের উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হবে না, অনেক বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হারিয়ে যাবে। সাফারি পার্ককে কেন্দ্র করে আশপাশে অনেক ধরনের স্থাপনা গড়ে উঠবে। মানুষের আনাগোনো বাড়বে। বন্য প্রাণীর প্রজননসহ বাসস্থান মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজারের জেলা সমন্বয়ক আ স ম ছালেহ সুহেল প্রথম আলোকে বলেন, লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। লাঠিটিলার জীববৈচিত্র্য ও ভূমির যে বৈশিষ্ট্য, তা দেশের অন্য কোথাও নেই। এই বনের সঙ্গে ভারতের সীমান্তসংলগ্ন বনভূমির যোগসূত্র আছে। বন্য প্রাণীর অবাধ চলাচল আছে। এখানে সাফারি পার্ক হলে জীববৈচিত্র্যের জন্য এই পরিবেশ থাকবে না।

ছালেহ সুহেল বলেন, এখানে সাফারি পার্ক করা হলে সংরক্ষিত বন ঘোষণা উপহাস ছাড়া আর কিছু নয়। সংরক্ষিত বনকে তার মতো থাকতে দিতে হবে। দেশের অন্যান্য সাফারি পার্কই ভালো চলছে না। এটি সরকারের অর্থের অপচয়ের কারণ ছাড়া কিছু হবে না। লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক তৈরির উদ্যোগ, তৎপরতা বন্ধ করা দরকার।

বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের অন্যতম ক্রান্তীয় চিরসবুজ ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনভূমি হচ্ছে লাঠিটিলা। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নে অবস্থিত এই বনভূমির আয়তন ৫ হাজার ৬৩১ একর। এই বনে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীগুলোর মধ্যে হাতি, উল্লুক, মায়া হরিণ, উল্টোলেজি বানর, আসামি বানর, মুখপোড়া হনুমানসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্লভ পাখির বসবাস রয়েছে। বন বিভাগ লাঠিটিলায় ৯৮০ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয় ধরে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। সাফারি পার্কে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ দর্শনার্থী আসবেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন