শতবর্ষী মেরাদিয়া হাট

দখল আর দূষণে নড়াই নদ আজ মৃতপ্রায়। পানি হয়েছে কালো। তবু এর বুক চিরেই মেরাদিয়া হাটের ঘাটে নৌকা এসে ভেড়ে আজও l ছবি: প্রথম আলো
দখল আর দূষণে নড়াই নদ আজ মৃতপ্রায়। পানি হয়েছে কালো। তবু এর বুক চিরেই মেরাদিয়া হাটের ঘাটে নৌকা এসে ভেড়ে আজও l ছবি: প্রথম আলো

গ্রামগঞ্জে সাপ্তাহিক হাট একটি সাধারণ বিষয়। শাক-সবজি, খাবারদাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। হাটুরেরা আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। কিন্তু নগর, মহানগরের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশ বেমানান। আর সেটা যদি হয় খোদ রাজধানীতেই, তাহলে একটু বিস্মিত হওয়ারই কথা।
রাজধানীর বুকে এমনি একটি হাটের নাম হলো ‘মেরাদিয়া হাট’। উচ্চারণের আঞ্চলিকতায় অনেকে বলেন ‘মেরাইদ্দা হাট’। বসে প্রতি বুধবার। ভোর থেকেই রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাটুরের দল নৌকায় করে নানান জিনিস নিয়ে নড়াই নদের (রামপুরা খাল) পাড়ে হাজির হন। অতি প্রাচীন কাল থেকেই লোকমুখে প্রচলিত আছে, ‘মেরাদিয়া হাটে সুঁই থেকে শুরু করে হাতিও মেলে।’
স্থানীয় বাসীন্দাদের কাছে এ হাট খুব জনপ্রিয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে এই হাটে বেচাকেনা করতে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে হাটবারের ভোর থেকেই জমজমাট হয়ে ওঠে মেরাদিয়া হাট। বিক্রি ভালো হওয়ায় হাটের পরিসরও বেড়েছে। রাস্তার দুপাশে, খালি জায়গায় এখানে-সেখানে সবুজ সবজি, টাটকা মাছ ও রঙিন পণ্যের সমাহার। কাছের হাটুরেরা মাথায় করেই নিয়ে আসেন নিজেদের পণ্য। কেউ শাক-সবজি, কারও গাছের ফল, কেউবা নিজের পালিত গরু, ছাগল, হাস-মুরগি, কেউবা নিয়ে আসেন নিজের গাভির টাটকা দুধ, আরও কত কী। একটু খালি স্থানে হাতের কাছে যা পান তাই টেনে বসে পড়েন। গাছের পাতা, কাগজের ছেঁড়া টুকরা প্রভৃতি। কেউ আবার শাবল-খুন্তি হাতে মাটি খুঁড়ে বাঁশ পুঁতছেন। শামিয়ানা, ত্রিপল, কাপড় বাঁধছেন বাঁশের মাথায়। আবার কোথাও খোলামেলা সব। সবকিছু মিলিয়ে বনশ্রীর এই মেরাদিয়া হাট যেন এক দিনের মিলনমেলা।
বাঁশ ও শুঁটকির জন্য এই হাটের বেশ সুনাম আছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিস পাওয়া যায় এখানে। গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন সবজি উঠেছে হাটে। রাস্তার দক্ষিণে সবজির পসরা। রাস্তার উত্তরে মাছ ও নানান ধরনের ফল। পূর্বে আছে বাঁশ ও শুঁটকি। পশ্চিমে কাপড়ের দোকান।
নড়াই নদের ঘাটে বাঁধা সারিবদ্ধ নৌকা ও ট্রলার। দূর-দূরান্ত থেকে হাটে এসেছেন অনেকে। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক আর দরদামে মুখরিত বিশাল এলাকা। নৌকায় ভরে হাটে এসেছে গাছ থেকে পেড়ে আনা জাম্বুরা, পেঁপে, পেয়ারা, আমলকী, আমড়া, কতবেল, ডাব, লেবু, পানিফল, জলপাই, সুপারি, বিভিন্ন প্রজাতির কলা। সদ্য গাছ থেকে কেটে আনা কলার কাঁদি ট্রলার থেকে নামানো হচ্ছে। কোনো এক ব্যবসায়ী ডাক দিলেন, ‘ফরমালিন ছাড়া কলা, ৪০ টাকা ডজন।’ কেউ এনেছেন গাভির দুধ, কেউ বিক্রি করছেন মাছ ধরার পলো, বড়শি, বড়শির ছিপ, পাটি, মুড়ি, মুরকি, গুড়। এ ছাড়া আছে বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি। পথের ধারে তালা কিংবা ছাতা মেরামতের কারিগরেরাও বসে পড়েছেন নিজেদের যন্ত্রপাতি নিয়ে।
সড়কের পাশে পড়ে থাকা খালি জায়গায় বাহারি পণ্যের ক্রেতা-বিক্রেতার মিলনমেলা। সবচেয়ে বেশি দেখা মিলল কাপড়ের দোকান। রাজধানীর নিউমার্কেট, গুলিস্তান, মতিঝিল, ফার্মগেট এলাকার ফুটপাতের অনেক ব্যবসায়ী বিচিত্র পণ্যের দোকান নিয়ে এসেছেন। নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, যুবক-বৃদ্ধ প্রায় সব বয়সের কাপড়ের দোকান বসেছে।
পশ্চিমে সারিবদ্ধ বসেছেন শাক-সবজির বিক্রেতারা। লালশাক, পুঁইশাক, কচুশাক, মুলা, ডাঁটা, হেলেঞ্চা, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, আলু, পটোল, শিম, করলা, ঝিঙে, লাউ, চালকুমড়াসহ আরও অনেক সবজি উঠেছে। সব টাটকা। দামও তুলনামূলক কম। রাস্তার উত্তরে মাছের হাট। অস্থায়ী এসব দোকানে উঠেছে দেশি কই, মাগুর, শিং, পুঁটি, চিংড়ি, খলশে, টেংরা, চান্দা, মলা, টাকি, শোল প্রভৃতি। বিক্রেতারা জানালেন, এগুলো বিভিন্ন নদী-নালা, পুকুর, জলাশয়, বিল কিংবা ডোবা থেকে ধরা। চাষের নয়। শিং মাছের হলদেটে রং দেখে বোঝাও গেল মাছগুলো চাষের নয়। হাঁস-মোরগের দোকানগুলোও এগুলোর ঠিক পাশেই। খাঁচি ছাড়াও দু-একটা করে বেঁধে রাখা হয়েছে।
মেরাদিয়া হাটে নারী ক্রেতাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। রামপুরা, বনশ্রী থেকে শুরু করে আফতাবনগর, বাড্ডা, খিলগাঁও, সাতারকুল, নাসিরাবাদ—এসব এলাকা থেকে আসেন অনেকে। বুধবারে হাটবার হওয়ায় কর্তাদের হাটে আসার সময় মেলে না। তাই গৃহিণীরাই হাটে আসেন কেনাকাটা করতে। বনশ্রীর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা শিরিন শিলা বলেন, ‘টাটকা সবজি, মাছ, ফলমূল কিনতে প্রতি বুধবার এই হাটে আসি। সব টাটকা আর দামও একটু সস্তায় পাওয়া যায়।’
হাটবারের দিন হাটুরে ও বিক্রেতারা সুদূর ফকিরখালী, ডেমরা, বাড্ডা, বেরাইদ, ইছাপুরা, রূপগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ থেকে হাট করতে আসেন। এ ছাড়া নাসিরাবাদ, রামপুরা, বনশ্রী, ভুলতা, চনপাড়া, খিলগাঁওয়ের আশপাশের এলাকা থেকে তো আসেনই।
হাটে আসা মানুষ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কবে এই হাট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা সঠিক কারওই জানা নেই। স্থানীয় ব্যক্তিরা এই হাটকে অনেক প্রাচীন বলেই জানেন। অনেকেই বলেন, তাঁদের বাপ-দাদারা পর্যন্ত এখানে হাট করেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, ব্রিটিশ শাসনামলে কোনো এক জমিদার এই হাট চালু করেন। হাটের প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে অনেকের অনেক মত থাকলেও অধিকাংশই মনে করেন যে হাটের বয়স প্রায় ২০০ বছর হবে। কালের বিবর্তনে অধুনিকতার ছোঁয়ায় পাড়া-মহল্লায়, অলিগলিতে আজ দোকানপাট, বাজারঘাট গড়ে উঠলেও টিকে আছে রাজধানীর এই শতবর্ষী মেরাদিয়া হাট। নড়াই নদের পানি কালো হয়ে গেছে। দখল আর দূষণে নদী আজ মৃতপ্রায়। তবু এর বুক চিরেই মেরাদিয়া হাটের ঘাটে নৌকা এসে ভেড়ে আজও।