বেনারসি শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত একজন কারিগর। ছবিটি সম্প্রতি মিরপুর বেনারসিপল্লি এলাকা থেকে তুলেছেন আশরাফুল আলম
বেনারসি শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত একজন কারিগর। ছবিটি সম্প্রতি মিরপুর বেনারসিপল্লি এলাকা থেকে তুলেছেন আশরাফুল আলম

বেনারসিপল্লির তরুণদের এখন আর দিনরাত মাকু (সুতা প্যাঁচানোর যন্ত্র) ও সুতা ঘুরিয়ে শাড়ি বুনতে দেখা যায় না। কম পারিশ্রমিকের কারণে পৈতৃক পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন পুরোনো কারিগরেরা। কারিগরদের নতুন প্রজন্মের সদস্যদের আগ্রহ নেই এ কাজে।

সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করেই কেবল তরুণদের এ পেশায় ধরে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন পুরোনো কারিগরেরা। আর তরুণেরা বলছেন, ‘যথেষ্ট’ পারিশ্রমিক পেলে এ পেশায় কাজ করতে আপত্তি নেই; বরং ভালোই লাগবে।

মিরপুর বেনারসিপল্লিতে সরেজমিনে জানা যায়, ভারতীয় শাড়ির চাকচিক্যে এবং সুতার দামের ঊর্ধ্বগতিতে দেশীয় শাড়ির ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। দেশি শাড়ির বিক্রি কমে যাওয়ায় এবং লাভ কমে যাওয়ায় বেনারসি পল্লির মহাজনেরা তাঁত কারখানায় শাড়ি তৈরি কমিয়ে দিয়েছেন।

কারিগরদের গদিতে বসে আলাপে জানা গেল, জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম বাড়লেও বাড়ছে না বেনারসির কারিগরদের পারিশ্রমিক। তাই এ পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। তৈরি হচ্ছে না শাড়ি তৈরির নতুন কারিগর। সংসার চালাতে পুরোনো কারিগরেরাও বদলে ফেলছেন পেশা।

মিরপুর ১০ নম্বরের মো. সুলায়মানের বয়স ২৭। তাঁর বাবাকে দেখা যায় পরম যত্নে সিল্ক কাতান শাড়ি তৈরি করতে। তাঁর দাদাও ছিলেন শাড়ি তৈরির কারিগর। কিন্তু সুলায়মান ভ্যানে সবজি বিক্রি করেন। এতে দিনে ৫০০ টাকার বেশি লাভ থাকে। মাসে ১৫ হাজার।

অন্যদিকে তাঁর বাবার মাসিক আয় ছয় হাজার টাকার মতো। সুলায়মান বলেন, ‘দিন-রাইত কষ্ট কইরা এই কয় ট্যাকা কেন কামাই করমু? আর এই ট্যাকায় সংসারও চলে না।’

একই কথা মিরপুর ১০ নম্বরের মাদ্রাসা ক্যাম্পের ২৪ বছর বয়সী মো. হারুনের। তিনি একটি বাসে সহকারীর কাজ করেন। দুই বেলার খাবারসহ মাসে আয় ভালোই।

বেনারসি পল্লির বাসিন্দারা জানান, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ভারতের বেনারস থেকে বেশ কিছু মুসলিম পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসে। শুরুতে ঢাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করতে থাকলেও পরে মিরপুর অঞ্চলে থিতু হয় তারা। পেশা হিসেবে বেছে নেয় তাঁতে কাপড় বোনা। এভাবেই মিরপুর বেনারসি পল্লির গোড়াপত্তন। তাদের ধারাবাহিকতায় যুদ্ধপরবর্তী আটকে পড়া পাকিস্তানিরাও এ পেশায় আসে।

ধীরে ধীরে বেনারসি শাড়ির চাহিদা বাড়তে থাকায় বাঙালিরাও এ পেশায় আসে। মিরপুরের উত্তরাংশ মূলত মিরপুর ১০ নম্বর, ১০ নম্বরের মাদ্রাসা ক্যাম্প, মিরপুর ১১ নম্বরের এ, সি, ই ব্লক, মিরপুর ১২ নম্বরের ই ব্লকের মিল্লাত ক্যাম্প, মুড়াপাড়া ক্যাম্প, কুর্মিটোলা ক্যাম্প ও কালশীতে কেবল কানে আসত তাঁতের খটখট শব্দ। চলত মহাজনদের তদারকি। দিনরাত শাড়ি বুনতে ব্যস্ত থাকতেন কারিগরেরা।

বেনারসি পল্লির সেই সোনালি সময় এখন অতীত। এখন থেমে থেমে তাঁতের শব্দ শোনা যায়। অনেক গদিঘর (তাঁত কারখানা) বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েক ঘর পরপর দু-একজন কারিগরের দেখা মেলে, তাঁদের মধ্যে অল্প বয়সী কারিগর হাতে গোনা।

মো. মনসুর মিরপুর ১০ নম্বরের মাদ্রাসা ক্যাম্পের একটি তাঁত কারখানার মালিক। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি এ পেশায় যুক্ত। তিনি ১৯৮২ সালের স্থানীয় তাঁতিদের করা একটি হিসাব দেখান। তাতে দেখা যায়, বেনারসিপল্লিতে তখন মহাজনের সংখ্যা ছিল পাঁচ শর মতো। আর কারিগর ১১ হাজারের অধিক। তিনি জানান, সেই সংখ্যা কমে গিয়ে এখন শ দুয়েক মহাজন টিকে আছেন। আর কারিগর আছেন হাজারখানেক। নতুন কারিগর তৈরি হচ্ছে না। পুরানোরাও ছেড়ে যাচ্ছেন।

বেনারসি পল্লির কারিগরেরা জানান, সকাল ৮টা থেকে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত কাজ করে মাসে চার থেকে সর্বোচ্চ ছয়টি শাড়ি তৈরি করা যায়। আর এতে মাসে সাকল্যে আয় হয় চার থেকে ছয় হাজার টাকা।

এ বিষয়ে বেনারসি পল্লির মহাজনেরা বলছেন, সুতা ও অন্যান্য অনুষঙ্গের মূল্যবৃদ্ধি এবং সনাতনি পদ্ধতিতে শাড়ি বানানোর ফলে ভারতীয় শাড়ির তুলনায় দেশি শাড়ির চাহিদা কমে গেছে। এ জন্য কারিগরদের মজুরিও বাড়ানো সম্ভব হয় না।

মো. মনসুরের কারখানার ছয়টি তাঁতের পাঁচটিই বন্ধ হয়ে গেছে। মো. মনসুর বলেন, সব খরচ মিটিয়ে প্রতিটি শাড়িতে আগে কমপক্ষে ৫০০ টাকা লাভ থাকত। এখন ১০০ টাকাও হয় না। কারিগরদের মজুরি বাড়াব কীভাবে।

একই কারণে এ ক্যাম্পের মো. সিরাজের কারখানাটিও বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘বেনিফিট নাই। ছেলে-মেয়ের খাবারের টাকা হয় না। শাড়ি বানাইয়া ঘরের সবাইকে কি না খাইয়ে রাখব?’

শাড়ি বানানো ছেড়ে রিকশা চালাচ্ছেন মো. সালাম। তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বাড়ছে। দিনরাত কাজ করেও তিন বেলা খাবার জোটানো কষ্ট। আগে মাসে আয় ছিল হাজার পাঁচেক, এখন আয় ১৫ হাজারের মতো বলে জানান তিনি।

৩৩ বছর বয়সী মো. গিয়াসউদ্দিনও এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘ছোটকাল থেকে এ কাজে লাগছিলাম। সংসারের খরচ চলে না বলে ছেড়ে দিয়েছি।’

ব্যবসায়ী, মহাজন ও কারিগরেরা বলছেন, তাঁদের বাঁচাতে সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বেনারসি পল্লির ঐতিহ্য ফুরিয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাশাপাশি, ভারতীয় শাড়ির অবাধ আমদানিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে নিয়ন্ত্রণেরও দাবি জানান তাঁরা।