শিকারি যখন নিজেই শিকার হয়ে যান

কামালের মুখে বাঘের থাবার দাগ দশ বছরের পুরানো
ছবি: সংগৃহীত

প্রয়োজনের কাছে মানুষের মৃত্যুভয় পরাজিত হয়। মাত্র ২২ বছরেই কামাল হোসেন জেনেছিলেন, বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। সে অভিজ্ঞতার প্রমাণ তাঁর মুখ থেকে পেঁচিয়ে লতার মতো মাথার পেছনে ঘুরে যাওয়া ক্ষতের দাগ। পরিচয় জানতে চাইলে হাসতে হাসতে জানালেন, ‘পরিচয় বদলে যায়, আপা। মধু আনতে গেলে মৌয়াল। মাছ ধরলে জেলে আর কাঠের জন্য বনে গেলে বাওয়াল বা বাউলে হয়ে যাই।’
কয়রা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কামাল এখন তুমুল তুফানেও নৌকার কাছি ধরে নির্বিকার এগিয়ে যেতে পারেন সাগরের দিকে। প্রয়োজনে নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়ে ধারালো দা দাঁতে কামড়ে সাঁতরাতে জানেন স্রোতের বিপরীতে। যে নদীর বাঁক আর বনের সব অন্ধিসন্ধি নিজের হাতের তালুর মতো পরিচিত, সেখানেই ভয়ে কয়েক বছর যাননি তিনি।

২০১১ সালের জ্যৈষ্ঠ তখন। তীব্র গরমে থমথমে বন। গাছপালা হলেও ‘তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে’ ভাবার সুযোগ নেই। এক খাঁড়ি থেকে আরেক খাঁড়িতে গেলে বাতাসে শব্দের প্রতিধ্বনি বদলে যায়। তরুণ কামাল ছোট নৌকা নিয়ে রওনা হয়েছিলেন কয়রার সদর থেকে। স্থানীয় মানুষের মুখে সে জায়গার নাম ‘মানসিলা’। সাড়ে তিন ঘণ্টার নৌকাপথের পর ‘গন্ডার খাল’। বনজীবীদের ভাষায় ‘গেরার নল বুনি’। সেবারের যাত্রা মধুর জন্য। সারা দিন ঘুরেও কিছু না পেয়ে কিছুটা হতাশ রুহুল আর কামাল। আবার সেই দীর্ঘ পথ ধরে ফেরা। বিকেলে জোয়ারের আগে ফেলে রাখলেন জাল। পরদিন সকালে গুটিয়ে নিলেই হবে। যতটুকু আসে, তাতেই লাভ।

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মানুষের শরীরের শিরা–উপশিরার মতো বয়ে গেছে ছোট ছোট খাল, খাঁড়ি, নালা ও নদী। মানচিত্রে আপাত দেখতে সরল হলেও আদতে সরল নয়। নৌকা বাইতে বাইতে কোথাও উঁচু আবার কোথাও নেমেছে অনেকখানি। নিচু এলাকাকে স্থানীয় লোকজন বলেন নামা। এমন অনেক সুড়ঙ্গ নদী আছে, যার অস্তিত্ব গুগল ম্যাপে কখনো পাওয়া যাবে না, কিন্তু বনজীবীদের মুখস্থ। আগের দিন বিকেলে জাল ফেলে খাঁড়ি ধরে ধরে ঘুরছেন দুই বনজীবী। মাঝরাতে আবার ফিরেছেন জালের কাছে।

কামালের মাথার পেছনে বাঘের থাবার ক্ষত
ছবি: সংগৃহীত

জোয়ারে মাছ উঠেছে অনেক। রাতভর জালের বন্ধনে যুদ্ধ করে হাল ছেড়ে গা এলিয়েছে মীন। ভোর ভোর সেই রুপালি প্রাচুর্য দেখে মুখটা হাসিতে ভরে যায় কামালের। নৌকার পাটাতনে ঝুঁকে জালের রশি টান দিয়ে দেখতে ভালো লাগছিল তাঁর।

বনের ভেতর গেরার নল বুনি জায়গাটি অসমতল। নদী সেখানে নামামুখী হওয়ায় পিঠের দিকে বনটা ছিল অনেক উঁচুতে। কামালের ভাষায়, ‘নিচে থাকলি নজর সহজে উপর দিক যাতি চায় না। বন তহন মাথার দিক। মাছ দেকতিছিলাম, সে দেকতিছিল আমারে।’ তাই মাছের দিকে লোভাতুর চোখে চেয়ে থাকা মানুষ বোঝেনি, লোভী চোখে তাকেও দেখছে কেউ। মুহূর্তে সেখানে তৈরি হয়েছে ত্রিমুখী এক চক্র। মাছের শিকারি হয়ে গেলেন নিজেই শিকার। তবু ব্যক্তিমানুষের কাছে নিজের জীবনের শেষ মুহূর্তের অনুভূতিই গভীর মৌলিক গল্প, যা অন্যকে বলার সুযোগ কম মানুষই পান। সৌভাগ্যে ফিরে আসা মানুষ কখনো বলতে পারেন, কখনো হয়তো সে গল্প থেকে সরিয়ে রাখেন নিজেকে। কামাল ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, কী হতে চলেছে! বাদাবনের নোনা জলের রুপালি মাছ দেখতে দেখতে তাঁর ছায়া পড়েছিল পানিতে। কামাল নিজের মুখের সেই পরিচিত হাসিটা শেষবার দেখেছিলেন তখন।

বাঘ নিজের শিকারের দিকে অটল থাকে শেষ পর্যন্ত। অপর দিকে বইঠা হাতে বসা রুহুল আমিনের চেয়ে পাটাতনে শুয়ে খানিকটা নদীতে ঝুঁকে থাকা কামালই আক্রমণের জন্য যোগ্য তখন। উঁচু বনের গেওয়া, গরান, হেঁতাল ছাড়িয়ে বাতাসে ভাসছে এক উৎকট গন্ধ। চোখের পলকে লাফিয়ে নৌকায় উঠে কামালের ঝুঁকে থাকা মাথায় থাবা বসিয়ে দিল। নখ গেঁথে গেল ২২ বছরের যুবকের ডান চোখের কোনায়। ছিঁড়েখুঁড়ে গেল মুখ আর মাথা। অপর প্রান্তের রুহুল সরদারও কম সাহসী নন। মাত্র কয়েক হাতের ব্যবধান। রুহুল পানিতে ঝাঁপিয়ে না পড়ে স্থির বসে ছিলেন বাঘের চোখে চোখ রেখে। ততক্ষণে কামালকে চার পায়ের ভেতর পেটের তলায় টেনে নিয়ে চেপে ধরেছে বাঘ। উল্টো দিকে বসে থাকা মানুষকে ঘায়েল করতে পারলেই সে নিরাপদ। প্রয়োজনে মুখে করে টেনে নেবে বনে। জ্ঞান হারানোর আগে কামাল শুধু রুহুলকে বলেছিল, ‘পিঠের ছালে বাড়ি মারো, চোখের ফিলে কাদা ছুড়ো।’ এরপর কিছু মনে নেই তাঁর। বাঘটিকে ধরা যায়নি, তবে রুহুলের দক্ষতায় বাঘকে আঘাত করে পানিতে ফেলে দিয়ে জোরে নৌকা চালিয়ে ফিরে আসা সম্ভব হয়েছিল। ততক্ষণে কামাল বেঁচে আছে না নেই, অনিশ্চিত।

সাড়ে তিন ঘণ্টার নৌকাপথ পাড়ি দিয়ে কামালকে নিয়ে যাওয়া হয় কয়রার জায়গিরমহল হাসপাতালে। সেখান থেকে খুলনার আড়াই শ বেড হাসপাতাল। থলের শেষ পয়সাটিও ফুরিয়ে যাওয়ার পর আধাআধি চিকিৎসা করে কয়েক মাস পর বাড়ি ফিরেছিলেন কামাল। গ্রামের মানুষ ভিড় জমিয়েছে, সাংবাদিক এসে ছবি তুলেছে, বহুজন আশ্বাস দিয়েছিলেন সহায়তার। মানুষের প্রাথমিক উত্তেজনার উপশম হলে অনাগ্রহের ঘটনা নতুন কিছু নয়। হওয়ার মধ্যে এক, নামটা ঝালাই হয়েছে নতুন করে। ব্রিটিশ আমলে যেমন নবাব খেতাব দেওয়া হতো, তেমনি গ্রামের মানুষ তাঁর নাম দিলেন ‘টাইগার কামাল’। ভয়ে অনেক দিন আয়নায় নিজের মুখ দেখেননি তিনি।

এক দশক আগের সে দাগ এখনো জ্বলজ্বলে। ডান চোখের কোনায় দেড় ইঞ্চি গর্ত হয়েছিল। কামালের ভাষায়, ‘নালি ঢুইকেছিল।’ এরপর পাঁচ বছর তিনি আর বনে যাননি। তবে বনজীবী মানুষের জন্য সেসব দুর্বলতা মেনে নেওয়া বিলাস। নগরের মানুষ আজ এ পথে খোঁড়াখুঁড়ি দেখলে পরের দিন যাতায়াতের জন্য ভিন্ন গলি খোঁজেন। এ দোকানের খাবার ভালো না হলে অন্য দোকানে অর্ডার। কিন্তু বননির্ভর মানুষের জীবন এমনই যে বিকল্পের অবকাশ নেই। হয় উদ্বাস্তু হয়ে জনসংখ্যায় মিশে যাও, নাহলে বুক পেতে দাঁড়াও স্রোত আর জোয়ারের বিপরীতে। মনের সাহস নিয়ে আবার ফেরো বনে। যে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছ, সে মৃত্যুকেই বুড়ো আঙুল দেখাতে পারলে আছে বাঁচার অধিকার। ভয়ের মুখোমুখি হয়ে প্রমাণ করো, শেষ পর্যন্ত মানুষই বিজয়ী।

পাঁচ মাস বন্ধ থাকার পর ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবার খুলে দেওয়া হয়েছে সুন্দরবন। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের ডিএফও আবু নাসের মোহসিন হোসেন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, প্রথম দিন বনে প্রবেশ করেছেন দুই হাজারের বেশি জেলে। খুলনার নালিয়া দিয়ে ১ হাজার ২৭ জন আর সাতক্ষীরা দিয়ে প্রবেশ করেছেন ১ হাজার ৮৫ জন। প্রথম দিনে সাতক্ষীরার কলাগাছিয়া দিয়ে পর্যটক প্রবেশ করেছেন ৪৯ জন। প্রায় দুই হাজার জেলের সবাই সুস্থ শরীরে ফিরবেন প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে তেমন ভাবা কঠিন। তাঁদের পরিবারের মানুষ অপেক্ষা করবেন অধীর হয়ে।

জেলেদের যেতে হয় কোম্পানির মাধ্যমে। একেকটা ছোট কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকেন এক থেকে দেড় শ জেলে। টাইগার কামালদের এবার নানা বিধি–ব্যবস্থার মধ্যে পাস, পারমিট পেতে পেতে বৃহস্পতিবার দুপুর হয়েছে। সন্ধ্যার মুখে সাগরের দিকে রওনা হয়েছেন টাইগার কামাল আর তাঁর দুই সহযাত্রী। কামালের হাতে এখন এক সপ্তাহের পাস। এ পাসের দাম ৫৫০ টাকা। এক মাসে দুবার এমন অনুমতি পাওয়া যায়। অর্থাৎ বেশি হলে ১৫ দিন উপার্জনের শ্রম বিনিয়োগের সুযোগ।

সাত দিনের পাস নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছে কামাল
ছবি: সংগৃহীত

ছোট একটা নৌকা থাকলেই রওনা হওয়া যায় না। এক সপ্তাহের রসদ গোছাতে হয়। রান্না–খাওয়ার মিষ্টি পানিও এখন সঙ্গে নিতে হয়। আগে নদীর কোনো কোনো জায়গায় স্বাদুপানি পাওয়া যেত। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে এখন স্বাদুপানির অভাব। বন বিভাগের বিধিনিষেধ আরও কঠোর হয়েছে। নদীতে জাল ফেলার জন্য কচা, বাঁশ, রান্নার কাঠ থেকে শুরু করে নৌকার ছাউনি—সব স্থলভাগ থেকেই নিয়ে যেতে হবে। বন থেকে সংগ্রহের সুযোগ নেই। বনসীমার ৩টি অভয়ারণ্য, নির্দিষ্ট ১৮টি খালে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। ২৫ ফুটের কম প্রশস্ত খালে কোনো জেলে বা মাছ ধরার নৌকা প্রবেশ করতে পারবে না। এক ইঞ্চির ছোট ফাঁসের কোনো জাল ব্যবহার করতে পারবেন না জেলেরা।
সাত দিনের জন্য বনের মধ্যে প্রবেশ করা জেলেরা নৌকায় নিয়ে যান বরফ। কখনো কখনো সে বরফে না কুলালে মাছ নষ্ট হয়। ফেরার পথে বড় মাছ ধরা পড়লে কখনো ফেলে দিতে হয় আগের ছোট মাছ। তখন কষ্টও হয়। ওই মাছের সঙ্গে থাকে তাঁর শ্রম ও সংগ্রহের আনন্দ।

কয়রার মহারাজপুরে মঠকড়ি দিয়ে রওনা হচ্ছেন জেলেরা
ছবি: সংগৃহীত

সব জেলেই মহাজনের কাছে বাঁধা। নৌকা, জাল, রসদের খরচ নিতে হয় তাঁদের কাছ থেকেই। কথা থাকে মাছ দিয়ে ঋণ শোধের। আমাদের টাইগার কামাল সব মিলে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা ধার করেছেন। এই যে তিনি রওনা হয়েছেন বিপৎসংকুল পথে, ফেরা আর না ফেরার দ্বৈরথে চেপে সে যাত্রার প্রায় অধিকাংশ আয়ই যাবে মহাজনের ধার শোধে। সমুদ্রের নোনাপানি আর প্রচণ্ড দাবদাহে ক্লান্ত এক মানুষ, যাঁর মুখ আর মাথায় মৃত্যুর রেখে যাওয়া দাগ, একটি চোখে ক্ষত। রাতভর সেখান থেকে পুঁজ বের হয় এক দশক ধরে। সে চোখে রোদে তাকাতে কষ্ট হয়। একটা বড় মাছ দেখে খুশিতে চকচক করে কামালের চোখ। একটু পরই আরেক হাতে উঠে যায় সেই রুপালি মাছ। ধারের শোধ।

বিষণ্ন, ক্লান্ত হাত ধমনির মতো খালের ভেতর দিয়ে কোনোমতে টেনে বায় বইঠা। অনেক দূরের পথ থেকে ফিরতে ফিরতে রাত নামে। নৌকা থামে কোনো বনের পাশে। দুই রশির জালের ভেতর তড়পায় মাছ। পাটাতনে ঝুঁকতেই হয়তো মনে পড়ে, পাশের বনেই অপেক্ষা করে আছে মৃত্যু। শিকার করতে গিয়ে আদতে জীবনের কাছে নিজেই শিকারে পরিণত হয়ে যান এই প্রকৃতিপুত্ররা। যাওয়ার আগে প্রথম আলোর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলেছেন টাইগার কামাল। বিনীত কণ্ঠে বলছিলেন, দোয়া করবেন, ফিরে আবার আপনাদের বাদার কথা বলব।