শিল্পায়নে সমৃদ্ধ হচ্ছে হবিগঞ্জ
উন্নত যোগাযোগ, পর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুৎ, সহজলভ্য জনবল আর কম মূল্যের জমির কারণে আমূল পাল্টে যাচ্ছে হবিগঞ্জের চিত্র। দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের কলকারখানা স্থাপনের জন্য বেছে নিচ্ছে হবিগঞ্জকে। ফলে পাহাড়, টিলা, হাওর, বনের দেশ পরিচিতি পাচ্ছে শিল্পনগরী হিসেবে।
হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ওলিপুর থেকে মাধবপুর উপজেলা সদর পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার এলাকার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুই পাশে তাকালেই চোখে পড়বে বড় বড় অট্টালিকা। মাত্র সাত থেকে আট বছরের মধ্যে এ সড়কের পাশেই গড়ে উঠেছে শতাধিক শিল্পকারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে জেলার লক্ষাধিক মানুষের। তবে এ শিল্পোন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবাদীরা।
দেশের অন্যতম গ্যাসক্ষেত্র হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড ও শাহজিবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রটি জেলার মাধবপুর উপজেলার শাহজিবাজারে অবস্থিত। এখানে গ্যাসের সুবিধা থাকায় গ্যাসভিত্তিক শিল্পকারখানার আধিক্য একটু বেশি। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে জমির মূল্য কম। সবচেয়ে বেশি শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে এ মহাসড়কের ওলিপুর এলাকায়। এখান থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতে পাড়ি দিতে হয় ১২০ কিলোমিটার পথ। জেলায় রয়েছে কর্মক্ষম বিশাল এক জনগোষ্ঠী। শিল্পবান্ধব এমন পরিবেশের কারণেই শিল্পপতিদের কাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হবিগঞ্জ।
মাত্র সাত থেকে আট বছরের মধ্যে হবিগঞ্জ এসে কারখানা করেছে বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ। এর মধ্যে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, স্কয়ার ডেনিমস লিমিটেড, স্কয়ার টেক্সটাইল, যমুনা গ্রুপ, রূপায়ন গ্রুপ, স্টার সিরামিক, স্টার পরসোলিন, আর কে পেইন্ট, চারু সিরামিক, পাইওনিয়ার বাদশা টেক্সটাইল, বাদশা টেক্সটাইল, সায়হাম টেক্সটাইল, যমুনা তাফরিদ কটন মিলস, সিপি বাংলাদেশ লিমিটেড উল্লেখযোগ্য।
ওলিপুর এলাকায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ২০১৪ সালে ২১৭ একর জমির ওপর গড়ে তোলে তাঁদের হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। একই এলাকায় স্কয়ার গ্রুপ ডেনিম কাপড় উৎপাদনের জন্য কারখানা নির্মাণকাজ শুরু করে ২০১৩ সালে। ৩০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত স্কয়ার ডেনিম কারখানা ও স্কয়ার টেক্সটাইলে বর্তমানে পুরোদমে চলছে উৎপাদন। স্কয়ার ডেনিমস লিমিটেডের এজিএম (প্রশাসন) মাহমুদ হোসেন বলেন, এসব শিল্পকারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকায় স্থানীয় স্বল্পশিক্ষিত ও অদক্ষ নারী-পুরুষেরাও এখানে চাকরি করছেন এবং উন্নত জীবন যাপন করছেন।
মাধবপুর উপজেলার কররা গ্রামে ২৬ বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে শতভাগ রপ্তানিমুখী ও স্বয়ংক্রিয় এসএম স্পিনিং মিল। এ মিলে প্রতিদিন উৎপাদিত হয় ৩২ থেকে ৩৫ মেট্রিক টন সুতা। এ মিলে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২ হাজার লোকের। এ ছাড়া যমুনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও রূপায়ন গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নানা রকম পণ্য উৎপাদন করে আসছে এ এলাকায়।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের অন্যতম উদ্দেশ্য গ্রামীণ এলাকার জনসাধারণের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। তা ছাড়া জ্বালানির সহজলভ্যতা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সে হিসাবে হবিগঞ্জে গ্যাস সহজলভ্য এবং রাজধানী ঢাকা থেকে এর দূরত্ব বেশি না। এসব বিবেচনায় হবিগঞ্জে শিল্পপার্ক গঠন করা হয়। শিল্পপার্ক স্থাপনের সাত বছরের মাথায় এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত পণ্য বর্তমানে বিশ্বের ১৪৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। গত সাত বছরে ২৪ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে। কারখানায় কর্মরত লোকবলের প্রায় ৮০ ভাগই স্থানীয়।
হবিগঞ্জ বণিক সমিতির সভাপতি মোতাচ্ছিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের জেলায় শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় প্রায় লক্ষাধিক লোকের কর্ম সংস্থান হয়েছে। তাতে এলাকাবাসী উপকৃতহ হচ্ছেন।’
নজর দিতে হবে পরিবেশে
ফসলি জমিতে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় কমেছে কৃষির উৎপাদন। পাশাপাশি অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্যে এলাকার নদ-নদী ও হাওর-জলাশয়ে দূষণ দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল বলেন, বড় বড় কলকারখানা গড়ে ওঠায় কর্মসংস্থান হয়েছে, জমির দাম বাড়ছে। ফলে এ এলাকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু কৃষিজমি নষ্ট করে, নদী-খাল, জলাশয়কে দূষিত করে গড়ে ওঠা এই শিল্পায়নের উন্নয়ন টেকসই হবে না। স্থানীয় জনগণের জন্য পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সেই দিকেও নজর দেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, তাঁরা পরিবেশের সুরক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাঁদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে বর্তমানে ৫টি ইটিপি রয়েছে, যার মাধ্যমে প্রায় দৈনিক ১ কোটি ৬ লাখ লিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব। লিকুইড বর্জ্য ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধন করা হয় আর সলিড বর্জ্য দিয়ে জৈবসার তৈরি করা হয়।
হবিগঞ্জ-৩ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবু জাহির বলেন, ‘আমরা শিল্প চাই। শিল্প ছাড়া একটি এলাকার উন্নয়ন হয় না। তবে শিল্পের দূষণের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। কোনো কোনো কোম্পানি এদিকে নজর না দেওয়ায় পরিবেশের ওপরও আঘাত হেনেছে। আমরা চাইব, এ বিষয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখে।’