শীতের পিঠায় আধুনিকতা

মাছের আদলে তৈরি এই পিঠার নাম মাছপিঠা। রাজশাহী নগরের পিঠাশিল্পী গুলশান আরার তৈরিছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভাপা পিঠা আগে শুধু গুড়–নারকেল দিয়েই বানানো হতো। আজকাল ভাপায় খেজুরের গুড়ের সঙ্গে শুকনো চেরি ফল ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা একেবারেই নতুন। এভাবে শীতের পিঠায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। সেই সঙ্গে পিঠার বাণিজ্যিক চাহিদাও তৈরি হয়েছে। গ্রামের পৌষ পার্বণ থেকে শীতের পিঠা এসে জায়গা করে নিয়েছে শহরের মেলায়। পিঠার সারিতে যুক্ত হয়েছে নতুন নাম। তবে আগেকার মতো গ্রামে পৌষ পার্বণ না হলেও শীতের পিঠা তৈরি করে আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করার প্রচলন এখনো রয়েছে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রসাদ পাড়া গ্রামের গৃহিণী মেহেরুন নেছা (৬০) বরাবরই শীতের পিঠা তৈরি করেন। তাঁর ভাষ্য, রাজশাহী অঞ্চলের মূল পিঠা হচ্ছে চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা ও পুলি পিঠা। নতুন ধানের চালের গুঁড়া আর খেজুরের রস বা গুড় দিয়েই মূলত আগে শীতের পিঠা তৈরি করা হতো। আগে পৌষ পার্বণে পিঠা উৎসব হতো। এখন উৎসব না হলেও পিঠা তৈরি করে আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়।

রাজশাহী কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সুকন্যা খন্দকার গত শনিবার শীতের পিঠার নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন খালার বাড়িতে। তিনি জানালেন, শীত এলেই নানার বাড়ি, খালার বাড়িতে পিঠার দাওয়াত পড়ে। চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, পুলি পিঠার সঙ্গে খালার বাড়িতে গিয়ে এবার খেয়েছেন নকশি পিঠাও। নকশি পিঠা নামে এখন অনেক নতুন নতুন পিঠা তৈরি হচ্ছে।

ইদানীং পিঠার বাণিজ্যিক চাহিদাও বেড়েছে। মেলা আয়োজনের পাশাপাশি বিভিন্ন অনলাইনে পিঠা বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে। রাজশাহীতে ‘চিরায়ত’ নামে ফেসবুক পেজ থেকে পিঠাশিল্পী গুলশান আরা পিঠা বিক্রি করে থাকেন। তাঁর বাসা রাজশাহী নগরের দেবিসিংপাড়ায়। সোমবার তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। মঙ্গলবার একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাবেন। এ জন্য তিনি ১৮ পদের পিঠা তৈরি করেছেন। পিঠাগুলো একে একে টেবিলের ওপরে সাজিয়ে রেখেছেন। তাঁর পিঠার দাম ও নাম দুটোই জানা গেল। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা দুধপুলি। এই পিঠা তিনি প্রতি কেজি ৪০০ টাকায় বিক্রি করেন। তাঁর পিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ চালের গুঁড়া ও খেজুরের গুড়। কোনো কোনো পিঠায় দুধ, দুধের ক্ষীর, নারকেল, ঘি, মাওয়া, চিনি, লবঙ্গ ইত্যাদি নতুন উপকরণ যুক্ত করেন। যেমন লবঙ্গ লতিকা পিঠার উপকরণ হচ্ছে ময়দা, নারকেল, ঘি, মাওয়া, লবঙ্গ, গুড় অথবা চিনি। ভাপা কুশলির উপকরণ হচ্ছে ময়দা, চালের গুঁড়া, নারকেল, দুধ ও খেজুরের গুড়। বিবিখানার উপকরণ হচ্ছে ময়দা, ঘি, নারকেল, চিনি, কিশমিশ ও মোরব্বা। দুধপুলিতে দেওয়া হয় চালের গুঁড়া, নারকেল, দুধ ও খেজুরের গুড়। তবে অধিকাংশ পিঠারই প্রধান উপকরণ চালের গুঁড়া, দুধ ও খেজুরের গুড়।

রাজশাহীর নকশি পিঠা

গুলশান আরার সর্বনিম্ন¤পিঠার দাম পাঁচ টাকা। তাঁর গোকুল পিঠা ৩৫০ টাকা কেজি, ক্ষীর পাটিসাপটা প্রতিটি ৩৫ টাকা, জামাই আদর ২৫০ টাকা কেজি, পাকান প্রতিটি ১০ টাকা, লবঙ্গ লতিকা ২৫, চন্দ্রপুলি ১৫, মাছ পিঠা ২৫, কাঁঠাল পাতা ১০, ফুলঝুরি ৬, ঝালকুশলি ৮, কুশলি ১২ টাকা করে, শঙ্খ ২ টাকা, তালবড়া ৩, ভাপাকুশলি ১০ টাকা করে এবং গোলাপ পিঠা প্রতিটি ২৫ টাকা।

রাজশাহী উইমেন চেম্বারের সভাপতি রোজেটি নাজনীন প্রতিবছর রাজশাহীতে পিঠা মেলার আয়োজন করেন। তিনি বলেন, ফাস্ট ফুডকে মোকাবিলা করার জন্য তাঁরা দেশীয় ঐতিহ্য শীতের পিঠা হাতে নিয়েছেন। একটু আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে পিঠাকে জনপ্রিয় করছেন। এটা নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই করছেন।