সাভারে ট্যানারিশিল্প
শ্রমিকের স্বাস্থ্যসেবা উপেক্ষিত
৭০ বছরের পুরোনো ট্যানারিশিল্প হাজারীবাগ থেকে ২০১৭ সালে হেমায়েতপুরে ‘বিসিক চামড়াশিল্প নগরী’তে স্থানান্তরিত হয়।
স্থানান্তরের পাঁচ বছরেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ঢাকার সাভারের চামড়াশিল্প নগরের শ্রমিক আবদুল কুদ্দুস গত ২৮ জানুয়ারি দুর্ঘটনার শিকার হন। সেদিন রাতের পালায় ডিউটি (কাজ) ছিল তাঁর। শিল্প এলাকায় কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। পরে সেই রাতেই হেমায়েতপুরের একটি ক্লিনিকে তাঁকে নিয়ে যান তাঁর সঙ্গীরা।
হেমায়েতপুরের ওই ক্লিনিকের চিকিৎসকেরা জানান, পরিস্থিতি জটিল, কুদ্দুসকে ঢাকায় নিতে হবে। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় তাঁকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে আনা হয় রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে। কুদ্দুসের হাত দুই জায়গায় ভেঙে গেছে বলে জানান চিকিৎসকেরা। বাড়ি ফিরে কুদ্দুস টের পান, তাঁর পাঁজরে তীব্র ব্যথা। আবার হাসপাতালে গেলে সেখান থেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা জানান, হাতে সার্জারি লাগবে। এতে দুই লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে। কুদ্দুস চলে যান গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলে। এক চিকিৎসক আত্মীয়কে ধরে বরিশালে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় অস্ত্রোপচার করান। এ পর্যন্ত চিকিৎসায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে বলে জানান কুদ্দুস। মালিকের পক্ষ থেকে মিলেছে ১৫ হাজার টাকা।
ট্যানারিশিল্পের শ্রমিকেরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। আগে হাজারীবাগে থাকার সময় যে অবস্থা ছিল, এর কোনো পরিবর্তন হয়নি।
গতকাল শনিবার মুঠোফোনে কথা হয়, কুদ্দুসের সঙ্গে। দুর্ঘটনার এ বর্ণনা দিয়ে একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন দুই সন্তানের এই বাবা। কুদ্দুস বলেন, ‘আর কোনো দিন কাজে যাইতে পারব কি না, জানি না। ছেলেমেয়েরা ঈদের কেনাকাটা করতে চায়। আমি কী দিমু কন? শরীরের এ অবস্থায় খাইতেও পারি না ঠিকমতো।’
সাভারের শিল্পকারখানায় স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় ১৩ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু তাঁদের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। এদিকে নজর নেই চামড়াশিল্পের মালিকদের, সরকারও উদাসীন। মালিকের সুদৃষ্টির অভাব ও সরকারি উদাসীনতার মাশুল দিচ্ছেন শ্রমিকেরা। এ অবস্থায় আজ রোববার পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস।
পরিবেশ ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে প্রায় ৭০ বছরের পুরোনো ট্যানারিশিল্প রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ২০১৭ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে ‘বিসিক চামড়াশিল্প নগরী’তে স্থানান্তরিত হয়। স্থানান্তরের পাঁচ বছরেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) ভালোভাবে কাজ করে না। ট্যানারির এই পরিবেশদূষণের বিষয় আলোচনায় এলেও শ্রমিকের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা কম। ট্যানারি শিল্পের একক শ্রমিক সংগঠন ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন কারখানায় সাতজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১১ জন।
সাভারে প্রায় ১৩ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের স্বাস্থ্য পরিষেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় আজ রোববার পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস।
ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে নানা ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয়। এ ছাড়া আছে যন্ত্রের ব্যবহার। শ্রমিকদের হতাহতের কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিষাক্ত গ্যাসে, হাউস বা ট্যাংক পরিষ্কার করার সময় গ্যাস দুর্ঘটনা বা অ্যাসিডদগ্ধ হয়ে, ঘুরন্ত ড্রামের আঘাতে শ্রমিকেরা হতাহত হন।
শ্রম আইনের ৯০ ধারা অনুযায়ী, ৫০ জনের বেশি শ্রমিক কাজ করেন, এমন যেকোনো শিল্পকারখানায় সেফটি কমিটি থাকতে হবে। দু-একটি বড় কারখানা বাদ দিয়ে সাভারের এই ট্যানারিশিল্পের কোনো কারখানার এই কমিটি নেই। হাজারীবাগ থেকে সাভারে আসার সময় শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের যেসব চুক্তি হয়, সেখানে একটি হাসপাতাল রাখার কথা বলা ছিল। আজ পর্যন্ত ছোটখাটো কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রও গড়ে ওঠেনি এ শিল্পকারখানায়।
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্যানারিশিল্পের শ্রমিকেরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। এখানে যে ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য এবং বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি আছে, সেগুলো নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেই। আগে হাজারীবাগে থাকার সময় যে অবস্থা ছিল, এর কোনো পরিবর্তন হয়নি।’
চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক)। শ্রমিকের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চামড়াশিল্প নগরীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান রিজওয়ান বলেন, ‘কয়েকটি এনজিওর সঙ্গে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে কথা বলেছি। আর এখানে একটি মেডিকেল সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে দ্রুত।’
কারখানাগুলোতে সেফটি কমিটি গঠন এখনো পুরোপুরি হয়নি বলে স্বীকার করেন ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত দুজন শ্রমিক মারা গেছেন—শ্রমিক ইউনিয়ন এ সংখ্যা বাড়িয়ে বলেছে।’
শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে শাহীন আহমেদের বক্তব্য, কাছাকাছি তো সরকারি হাসপাতাল আছে। তবে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের এসব বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবছেন বলে জানান তিনি।
মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে শ্রমিকনেতা আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য, ‘আমরা বাড়িয়ে বলব কেন? আমরা যে তালিকা দিয়েছি, তা তাঁরা মিথ্যা প্রমাণ করুক।’