শ্রম আদালতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয় মিলনাদের  

তৈরি পোশাক কারখানা
ফাইল ছবি

একটি পোশাক কারখানা থেকে চাকরিচ্যুত হওয়ার পর পাওনা বুঝে পেতে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন পোশাকশ্রমিক মিলনা। এরপর সাত বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে অনেকবারই হাজিরা দিতে হয়েছে তাঁকে। তবে তাঁর করা মামলার নিষ্পত্তি হয়নি এখনো। মালিকপক্ষও তাঁর বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা করেছে। ওই মামলায় তিনি জামিন নিয়েছেন। তবে সে মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি এখনো। মিলনার দাবি, মালিকপক্ষের কাছে তাঁর পাওনা প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

মামলার দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ মিলনা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রথম তিন বছর মাসে একবার করে গিয়েছি আদালতে, দুই মামলার জন্য। বাদী হিসেবে গিয়েছি, জবানবন্দির জন্য গিয়েছি। পরের দুই বছর আদালতে দুই মাস পরপর গিয়েছি, কারণ আমি বাদী। লকডাউনের পর যাওয়া হয় না।’

বারবার শুনানির তারিখ পিছিয়েছে, আর আদালতে ঘুরে মিলনার নষ্ট হয়েছে সময় ও অর্থকড়ি। ঢাকার খিলক্ষেতের বাসা থেকে দৈনিক বাংলা মোড়ের আদালতে যাতায়াত, জামিন, আইনজীবী—সব মিলিয়ে কত খরচ হয়েছে, হিসাব নেই মিলনার। মিলনাসহ চাকরিচ্যুত ১৩ জন মিলে মামলাটি করেছিলেন। সবার একই অবস্থা।

বর্তমানে আরেকটি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন মিলনা। তিনি বলেন, ‘যাতায়াতে প্রতিবার ২০০ টাকা খরচ। মামলায় গেছে হাজার টাকা। জামিনে ১ হাজার ২০০ টাকা করে লেগেছে। পোশাক কারখানার কাজ বাদ দিয়ে গেছি। দৈনিক ৭০০ টাকার মতো হাজিরা মাইর। এমনে বহুত টাকাই লস।’

শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের তথ্যমতে, দেশের ১০টি শ্রম আদালতে মোট ২৪ হাজার ৩১টি মামলা (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ঝুলে আছে। সর্বোচ্চ জট ঢাকার তিনটি শ্রম আদালতে—প্রথমটিতে ৭ হাজার ৭৫৭টি, দ্বিতীয়টিতে ৭ হাজার ৬৮৫টি ও তৃতীয়টিতে ৫ হাজার ৩০৮টি। পরের অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রামের দুটি শ্রম আদালত—প্রথমটিতে ১ হাজার ৯০৬টি ও দ্বিতীয়টিতে ৭০০টি। এ ছাড়া শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৩৪৬।

ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আদালতটিতে শেষ ৫ বছরে (২০১৭ থেকে ২০২১ সাল) মামলা হয়েছে ৭ হাজার ৮১৭টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ৪ হাজার ৮১৭টি, ফৌজদারি ২ হাজার ২৯২টি ও মিস মামলা (বিবিধ মামলা) ৭০৮টি। একটি মামলার রায় যাওয়ার পর কোনো পক্ষের অনুরোধে তা পুনরায় চালু হওয়াকে মিস মামলা বলে।

শ্রম আদালতে মামলাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ পোশাকশিল্প খাতের বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

আইনজীবী, ভুক্তভোগী ও আদালতের অন্যান্য সূত্রের তথ্যমতে, দেওয়ানি মামলাগুলো মূলত কর্মীদের বেতন বকেয়াসংক্রান্ত। অন্যদিকে ফৌজদারি মামলাগুলো মূলত কারখানামালিকদের আইন না মানা-সংক্রান্ত। মামলাগুলো করেছে মূলত কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডাইফ) পরিদর্শক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো। এ ছাড়া রয়েছে শ্রম আদালতের আদেশ অবমাননা-সংক্রান্ত মামলাও।

মামলাগুলোর নিষ্পত্তির হারও সন্তোষজনক নয়। সবচেয়ে বেশি মামলার জট প্রথম শ্রম আদালতে। এখানে প্রতি মাসে গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০টি মামলা হয়। আর গড়ে ১০০ থেকে ১৫০টি নিষ্পত্তি হয় বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

কেন দীর্ঘসূত্রতা

আদালত সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘসূত্রতার মূল কয়েকটি কারণ হচ্ছে মিস মামলা, বাদী-বিবাদীদের শুনানির দিন আদালতে না আসা, শুনানির নোটিশ না পাওয়ার অজুহাত ইত্যাদি। এর বাইরেও নানা কারণ রয়েছে।

লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম আহসান খান প্রথম আলোকে বলেন, শ্রম আইনের ২১৩ ও ৩৩ ধারার মামলায় সময় বেশি লাগছে। এসব ধারায় শুনানির সময় বিচারকের দুই পাশে দুজন সদস্য বসেন। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্যদের মধ্যে আদালতে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের একজন করে সদস্য উপস্থিত থাকার কথা। তাঁরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও ব্যস্ত। অনেক সময় শুনানিতে তাঁরা উপস্থিত থাকেন না। যদিও রায়ে সদস্যদের মতামত দরকার। এ কারণে রায় দীর্ঘায়িত হয়।

শ্রম আইনের ৩৩ নম্বর ধারাটি মূলত চাকরির লে অফ, ছাঁটাই, ডিসচার্জ, বরখাস্ত, অপসারণ বা অন্য কোনো কারণে অভিযোগ করা প্রসঙ্গে। আর ২১৩ নম্বর ধারাটি মূলত স্বীকৃত কোনো অধিকার প্রয়োগের জন্য কোনো শ্রমিকসংগঠন, মালিক বা শ্রমিক কর্তৃক শ্রম আদালতে দরখাস্ত করা প্রসঙ্গে।

আদালত সূত্র বলছে, ঢাকার ৩টি শ্রম আদালতে শ্রমিকদের জন্য ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। তাঁদের ১০ জনই সরকারি দলের সমর্থক, আদালতে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না। তবে মালিকপক্ষের সদস্যরা নিয়মিত উপস্থিত থাকেন।

আইনজীবী সেলিম আহসান খান আরও বলেন, ‘আদালতে কর্মচারীও খুব ক্ষমতাধর। কোনো কোনো বাদীর নথি দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যায় না। এগুলো কেউ না কেউ লুকিয়ে রাখছেন।’

বাংলাদেশ শ্রমিক সংহতি ফেডারেশন সভাপতি ও আইনজীবী রুহুল আমীন প্রথম আলোকে বলেন, আইনে শ্রম আদালতকে দেওয়ানি আদালত হিসেবে গণ্য করার কথা বলা আছে। এখানে দেওয়ানি আইন চলে। বাদীর সাক্ষ্য-জেরা, বিবাদীর সাক্ষী-জেরা হয়। তারপর যুক্তিতর্ক, রায়ের জন্য দিন ধার্য হয়। প্রায়ই মালিকপক্ষ নোটিশ পেয়েও উপস্থিত হয় না। এমনকি একতরফা রায়ের পরও নোটিশ পেয়ে আসে না। তখন রায় লঙ্ঘনের জন্য ফৌজদারি আইনে মামলা হয়। তখন মালিকপক্ষ ‘মিস কেস’ করে, সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা ‘খরচা’ (জরিমানা) দিয়ে তা মূল মামলায় চলে যায়। এভাবে ১০ বছরেও মামলা নিষ্পত্তি হবে না।

রুহুল আমীন বলেন, শ্রম আদালত বিশেষ আদালত। বিশেষ আইনে বিশেষ ব্যবস্থা না থাকলে নিষ্পত্তি দ্রুত হবে না।

আইনজীবীদের সম্পর্কে রুহুল আমীন বলেন, আইনজীবীর একটা লক্ষ্য থাকে, যত দিন মামলা থাকবে, তত লাভ। মালিকপক্ষের আইনজীবীরা আদালতের কাছে প্রতিবার তারিখ নেওয়ার জন্য তাঁদের কাছ থেকে ফি নেন। বিভিন্নভাবে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করেন।

দরকার ‘সংক্ষিপ্ত বিচার’

ঢাকার একটি শ্রম আদালতের চেয়ারম্যানের নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শ্রম আদালতের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দরকার সামারি ট্রায়াল (সংক্ষিপ্ত বিচার)। অন্যথায় মামলা আইন মেনে ১৫০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। মামলায় বিবাদীপক্ষের আইনজীবী সময় নেন অনেক বেশি। বাদীপক্ষের আইনজীবীরাও অনেক ক্ষেত্রে সময় চান ব্যক্তিগত স্বার্থে। মামলার ক্ষেত্রে বাদীরা আইনজীবীদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল, তার সুযোগ নেন আইনজীবীরা। এ ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত বিচারের বিকল্প নেই।

এই চেয়ারম্যান বলেন, আদালতে শ্রম আইনের পাশাপাশি দেওয়ানি আইন, সাক্ষ্য আইনের সাহায্য নিতে হয়। বিবাদী দোষ স্বীকার করলে সাক্ষ্যের প্রয়োজন নেই। এ জন্য আইন সংশোধন প্রয়োজন। না হলে শত শত আদালতের মাধ্যমেও মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ শ্রমিক সংহতি ফেডারেশন সভাপতি রুহুল আমীন বলেন, মামলার জট কমাতে সদস্যরা আদালতে উপস্থিত না হলেও বিচার চালিয়ে যেতে হবে। চেয়ারম্যান থাকলেই মামলা গঠিত হবে, মেম্বাররা না এলে তা বিঘ্নিত হওয়া উচিত নয়। আইনে সংশোধনী আনতে হবে। ১৫০ দিন পার হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে শেষ করার বিধান করা উচিত।

আইনের ফাঁকফোকর থাকলে দোষী ব্যক্তি ও আইনজীবীরা সুযোগ নেবেন বলে মন্তব্য করেন রুহুল আমীন।

‘আমি বাড়তি টাকা চাই না। শুধু চাকরিটা ফিরিয়ে দিলেই হবে’

আলম রানা ছয় বছরের বেশি সময় কাজ করেছেন নারায়ণগঞ্জের একটি নিটওয়্যার কারখানায়, কোয়ালিটি সুপারভাইজার পদে। মাসে ১৪ হাজার টাকা বেতন পেতেন। ২০১৭ সালে তাঁর চাকরি চলে যায়। রানা প্রথম আলোকে বলেন, একদিন কারখানার জিএম তাঁকে ডেকে সাদা কাগজে সই দিতে বলেন। তবে তিনি তাতে সই করেননি। জিএমের কাছে সইয়ের কারণ জানতে চেয়েও উত্তর পাননি। এর পর থেকে দারোয়ান তাঁকে কারখানার গেটের ভেতর ঢুকতে দেন না বলে অভিযোগ করেন রানা।

পরবর্তী তিন মাস কারখানায় প্রবেশের চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি আলম রানা। পরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে এলে তাঁকে নিয়ে জামালপুর গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তিনি বলেন, ‘টাকার অভাবে ছেলেটা মারা গেল। বউয়ের সিজার দরকার ছিল। কিন্তু করতে পারলাম না। প্রতিবন্ধী বোনটার জন্য কিছু করতে পারলাম না। সন্তান-চাকরি সবই হারাইলাম।’

গ্রামে যাওয়ার আগে আলম রানা ২০১৭ সালের অক্টোবরে শ্রম আদালতে মামলা করেন চাকরি ফিরে পেতে। তিনি বলেন, তিনবার আদালতে গিয়েছিলেন। কোনোবারই মালিকপক্ষ আদালতে আসেনি। দুইবার তিনি নিজে আসতে পারেননি। মধ্যে দীর্ঘ সময় করোনাভাইরাসের কারণে আদালত বন্ধ ছিল।

জামালপুর থেকে ঢাকায় আসার কথা বলতে গিয়ে আলম রানা বলেন, ‘সব মিলিয়ে ছয় হাজার টাকার মতো গেছে তিন দিনে। আগের দিন রাতে রওনা দিয়ে পরদিন মাঝরাতে বাড়িতে গেছি। এখন আর উকিল কিছু বলে না। ফোনও পাই না। খবরও পাই না।’

সন্তান মারা যাওয়ার পর বছরখানেক পাগলপ্রায় ছিলেন আলম রানা। এক বছর পুরোপুরি বেকার ছিলেন। পরবর্তী সময়ে গ্রামের বাজারে ধারদেনা করে দোকান খুলেছেন। বাকিতে পণ্য বেচে টাকা খুইয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার হক (চাকরি), সেটা ফিরিয়ে দিক। আমি বাড়তি টাকা চাই না। শুধু চাকরিটা ফিরিয়ে দিলেই হবে।’