সব পাঠকের জন্য

পল্টনে বায়তুল মোকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পাঠাগার। গত বৃহস্পতিবারের দৃশ্য l প্রথম আলো
পল্টনে বায়তুল মোকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পাঠাগার। গত বৃহস্পতিবারের দৃশ্য l প্রথম আলো

দৃশ্য: এক: বিদ্যুতের প্লাগ বোর্ডের নিচে সাদা কাগজে স্পষ্ট লেখা, ‘মোবাইল চার্জ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন’। মাঝবয়সী এক পাঠক পকেট থেকে ফোনটি বের করে ঠিক সেখানেই চার্জারটি ঢোকালেন। তারপর টেবিলে এসে বসলেন, ভাবলেশহীনভাবে।

দৃশ্য: দুই: সাদা কাগজে স্পষ্ট করে লেখা, ‘এখানে ফোন করা নিষেধ। ফোন আসলে দয়া করে বাইরে যান’। দেখা গেল, ক্রিং ক্রিং শব্দ করে ফোন এলেও কেউই বাইরে যাচ্ছেন না। টেবিলে বসেই কথা বলে চলেছেন। পাশে কারও সমস্যা হচ্ছে কি না, তা দেখার সময় নেই।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরির দোতলার পাঠকক্ষের দৃশ্য এটি। সময় ২২ নভেম্বর বেলা দুইটা।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি সুপ্রশস্ত নতুন ভবনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরি। দোতলা, তিনতলা ও চারতলাজুড়ে বিস্তৃত পাঠকক্ষ। দোতলার পাঠকক্ষটির একদিকে বাংলা বই, আরেকদিকে ইংরেজি। তিনতলায় আরবি-ফারসি ভাষার বই। আর চারতলায় রয়েছে সংবাদপত্র পাঠকক্ষ ও অন্যান্য বই।

সরেজমিনে দেখা গেল, দোতলায় ২৫-৩০ জন পাঠক। কেউ বই পড়ছেন, কেউ খাতায় নোট নিচ্ছেন। কেউবা মুঠোফোনে বইয়ের পাতার ছবি নিচ্ছেন। এক তরুণকে দেখা গেল একটি বইয়ের ছবি নিতে। কথা বলে জানা গেল, তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। লেখালেখি করেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে বইটি এখানে পেয়েছেন।

তিনতলায় পাঠক কম দেখা গেল। চারতলায় পাঠকসংখ্যা ছিল ৫০-এর কাছাকাছি। দৈনিক, সাপ্তাহিক ও অন্যান্য সাময়িকী মিলিয়ে দেশি-বিদেশি ৪০টি পত্রপত্রিকাই এখানকার প্রধান আকর্ষণ।

এই লাইব্রেরি সব ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। বইয়ের সংখ্যা লাখের ওপরে হবে। পবিত্র কোরআন, হাদিস, তাফসির, ইসলাম ও ইসলামসম্পৃক্ত বিষয়াবলি, মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, মুসলিম মনীষীসহ অন্যান্য মনীষীর জীবনী, সাহিত্য-শিল্প, শিশুসাহিত্য, বিভিন্ন ভাষার বিশ্বকোষ-জ্ঞানকোষসহ নানা মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য বইয়ে সমৃদ্ধ এ লাইব্রেরি।

লাইব্রেরিতে বিশেষভাবে রয়েছে হজরত উসমান (রা.)-এর সময়ের পবিত্র কোরআন শরিফ মাসহাফে উসমানী, রাজশাহীর বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক মোহাম্মদ হামিদুজ্জামানের হাতে লেখা ৬১ কেজি ওজনের ১ হাজার ১০০ পৃষ্ঠার সর্ববৃহৎ কোরআন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল কোরআন।

পাঠকের এই সংখ্যা স্বাভাবিক কি না, জানতে চাইলে এখানকার একজন সহকারী বললেন, শীতকাল অনুযায়ী পাঠক ঠিক আছে। মানুষ বেরোতে চায় না। গরমকালে পাঠক বেশি।

পাঠকদের একটি অংশ গবেষক, যাঁরা লেখালেখি করেন। এর বাইরে বায়তুল মোকাররম, পল্টন, গুলিস্তানের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা মাঝেমধ্যে লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারেন। আছে নিয়মিত পাঠকও, যাঁরা দূরদূরান্ত থেকে আসেন।

অনেকেই এখানে বসে চাকরির জন্য পড়াশোনা করেন। খাতা-কলম, ক্যালকুলেটর নিয়ে বসে যান। জানতে চাইলে এ রকম একজন বললেন, ‘বাসায় নিরিবিলি পরিবেশের অভাব। তাই এখানে এসে পড়ি। অনেকেই পড়ে।’ বাইরের বই নিয়ে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ—বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে তাঁর উত্তর, ‘ফটকে তো কেউ বাধা দেয়নি।’

কিছুটা ব্যতিক্রমসহ সরকারি অফিসের সময়সূচি মেনে চলে এই লাইব্রেরি। বন্ধ থাকে প্রতি শনিবার। শুক্র ও রোববার চালু থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এ ছাড়া অন্যদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা।

এই লাইব্রেরিতে এখন আর নতুন সদস্য করা হচ্ছে না। আর বই বাসায় নেওয়ারও অনুমতি নেই। সদস্যরা নিয়েছেন কিন্তু ফেরত দেননি, এ রকম বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। চিঠি দিয়ে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও কোনো ফল মিলছে না। গ্রন্থাগারিক সফিকুল ইসলাম তালুকদার মুঠোফোনে জানালেন, মাঝেমধ্যে বই চুরিরও ঘটনা ঘটে। অতি সম্প্রতি একজন ব্যাগ ভরে বই নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। পরে অঙ্গীকারনামা রেখে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ফি বছর ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বই কেনে এই লাইব্রেরি। আবার কিছু বই নষ্টও হয়।

এখানে শিশুদের ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সমৃদ্ধ পৃথক কর্নার আছে। এক প্রশ্নের জবাবে সফিকুল ইসলাম তালুকদার জানালেন, তাঁদের দেওয়া একটি প্রস্তাব সম্প্রতি পাস হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে অটোমেশনসহ লাইব্রেরিটির আধুনিকায়ন সম্ভব হবে। কিছু বই দেওয়া সম্ভব হবে ইন্টারনেটে।